“অপরাধ করেছেন কী করেন নাই এইসব বিবেচনা করবে না র্যাব। ধরা খাওয়া মানে ঢিসুম ঢিসুম। ক্রসফায়ার। আল্লাহ খোদার নাম নেন হিমু ভাই। দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে যান।”
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’ উপন্যাসের কথোপকথন এটি।
উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। আর র্যাবের সৃষ্টি হয় ২০০৪ সালে। তার মানে মাত্র দুই বছরের মাথায় র্যাবের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও ক্রসফায়ারের নির্মমতা ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল।
জন্মের পর থেকেই বিতর্ক ও কন্ট্রোভার্সির সঙ্গে জড়িত এই বাহিনীটিকে নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা ছিল তুঙ্গে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন সময়ে এটি বিলুপ্তের দাবি উঠেছে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে। তবে ক্ষমতাসীন দলগুলো কখনোই তা আমলে নেয়নি।
৫ আগস্ট দেশের রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের পর এই বাহিনীকে বিলুপ্ত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। বহাল আছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা।
র্যাবের বিলুপ্তি চায় বিএনপি
কালের পরিক্রমায় র্যাবের বিলুপ্তির দাবি এখন কেবল মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নয়, র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন হোসেন কিংবা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত টেকনাফের একরামুল হকের নয় –দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিরও দাবি হয়ে উঠেছে।
বিএনপির ৬ সদস্যের পুলিশ সংস্কার কমিটি রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে এই বাহিনীকে বিলুপ্ত করার।
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে তারা তাদের প্রতিবেদন তুলে ধরেন। দেশ-বিদেশের মহলে র্যাবের কর্মকাণ্ডে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে বিলুপ্তের সুপারিশ করে বিএনপি গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিটি।
যেভাবে র্যাব গঠন হলো
মজার বিষয় হলো, বিএনপির নেতৃত্বে থাকা জোট সরকারই ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ পুলিশের একটি ইউনিট হিসাবে র্যাব গঠন করেছিল। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের নামে প্রথমে সেনাবাহিনীকে দিয়ে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনা করে।
পরে ২০০৩ সালে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বাদ দিয়ে পুলিশের মধ্যে একটি ইউনিট গঠন করে, নাম দেয় ‘র্যাপিড অ্যাকশন টিম- র্যাট’। কিন্তু এর নামের সংক্ষিপ্ত রূপ র্যাট বা ইঁদুর নিয়ে হাস্যরস হলে সরকার পরিকল্পনা বদলায়। এরপর গঠন করা হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব। এটি পুলিশের অধীন হলেও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদেরও এতে যুক্ত করা হয়।
র্যাব গঠনের পর থেকে ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটি ও এর পেছনের গল্পটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। প্রত্যেক অভিযানে একই স্ক্রিপ্টে তথাকথিত সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের মৃত্যুর খরব পরিবেশন করা হতো। বলা হতো, ‘অভিযানে গেলে ওঁৎ পেতে থাকা অপরাধীরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধের পর অপরাধীরা পালিয়ে গেলে এক বা একাধিক জনের লাশ পাওয়া যায়।’
সমালোচনা ও বিতর্ক
র্যাবের ক্রসফায়ার বড় প্রশ্নের মুখে পড়ে ২০১১ সােলর ২৩ মার্চ ১৬ বছরের কলেজছাত্র লিমন হোসেনকে গুলি করার পর। র্যাবের এক অভিযানে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন লিমন। হাসপাতালে ভর্তির চার দিন পর লিমনের বাম পা কেটে ফেলতে হয়। বর্তমানে ঢাকার সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক লিমন এখনো কৃত্রিম পা নিয়ে চলাফেরা করেন।
এরপর ২০১৮ সালের ২৬ মে কক্সবাজারে মাদকবিরোধী অভিযানে র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা একরামুল হক।
র্যাব তখন ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছিল, তা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় ঘটনার ঠিক আগে মেয়ের সঙ্গে তার কথোপকথন এবং ঘটনার সময় তার ফোন থেকে স্ত্রীর কাছে আসা কলের কারণে।
একরামের মেয়ের বলা বাবার সঙ্গে শেষ কথা ‘আব্বু তুমি কান্না করতেছো যে’ তখন ক্ষোভ প্রকাশের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সোশাল মিডিয়ায়, অনেকে এই বাক্যটি লিখে ফেইসবুকে প্রোফাইল পিকচারও দিয়েছিল।
আবার নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মতো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও র্যাব কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, অতঃপর…
র্যাব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও বেশ মজার। শুরুর দিকে প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে র্যাবকে সহায়তা দিয়েছিল তারা। পরে ২০২১ সালে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনে জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তর বলেছিল, র্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬০০’রও বেশি লোকের গুম হয়ে যাওয়া, এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী।
সর্বশেষ এই সরকার দায়িত্ব নেয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে গত ২৬ আগস্ট র্যাব বিলুপ্ত করার জন্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে চিঠি দেন।