জানুয়ারি ২২, ২০২৪, ০৪:০৪ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জয়নব খাতুন (২৪)। কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার মণ্ডলপাড়ার কাঠমিস্ত্রি আবদুল জলিল এবং তাঁর স্ত্রী জুলেখা খাতুনের ছোট মেয়ে জয়নব থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে।
বংশে একমাত্র জয়নবই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে পেরেছিলেন। ঢাবিতে চান্স পাওয়ার পর টিউশনি করতে চাইলেও পরিবারের সদস্যরা বলেন টাকাপয়সার জন্য চিন্তা না করে শুধু পড়াশোনা নিয়ে থাকতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর ধারদেনা করে মেয়েকে পড়াশোনা করাতে থাকেন। স্বপ্ন দেখছিলেন মেয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে চাকরি করবেন। কিন্তু একটি দুর্ঘটনায় হারিয়ে গেল সব স্বপ্ন।
দুই ভাই এক বোনের মধ্যে জয়নব ছিলেন সবার ছোট। উপজেলার সিজি জামান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং রৌমারী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।
পড়ালেখার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমেও ছিল জয়নবের সরব উপস্থিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেঞ্জার ইউনিটের সদস্য, হিমু পরিবহনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ভ্রমণ কন্যার সদস্য ছিলেন। এছাড়া ভ্রমণ কন্যা- ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ-এর সেরা ভলান্টিয়ার এবং মুভার’স একটি সচেতনতামূলক সংগঠন যার শুভেচ্ছাদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
গত শনিবার সকাল ১১টার দিকে বান্দরবান জেলা সদর থেকে ফেরার পথে রুমা উপজেলায় বগালেক-কেওক্রাডং সড়কের দার্জিলিং পাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ঢাবি ছাত্রী জয়নব মারা যান। সে সময় আরও এক সহযাত্রী মারা যান। আহত হন আরও ১২ জন।
‘ভ্রমণকন্যা-ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের তত্ত্বাবধানে ৫৭ জনের একটি দল কেওক্রাডাং ভ্রমণে গিয়েছিল। দলে ৬০ বছর বয়সী নারী থেকে শুরু করে দুই শিশুও ছিল। ভ্রমণে সংগঠনটির রংপুর বিভাগের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জয়নবও ছিলেন।
ভ্রমণকন্যা-ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন চিকিৎসক সাকিয়া হক বলেন, ‘জয়নবকে খাদ থেকে তুলে আমার কোলে দেওয়া হয়। চিকিৎসক হিসেবে আমি দেখেই বুঝতে পারি, জয়নব আর নেই। এরপরও বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে দেখি। আর রিজভী নিচ থেকে ওপরে উঠে নিজেই বলেছে, মা তো আর নেই। এই যে যন্ত্রণা, তা আমাদের জীবনভর বয়ে বেড়াতে হবে। জয়নবের বয়স কম ছিল। ওর স্বপ্নেরা মাত্র ডানা মেলতে শুরু করেছিল। সব শেষ হয়ে গেল।’
শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা ও সাহস জোগাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী জয়নব খাতুনের কথা বলা হতো, তিনি এখন ঘুমিয়ে আছেন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার মন্ডলপাড়া গ্রামে এক কবরস্থানে।
জয়নবের ভর্তি পরীক্ষার সময়ের সংগ্রামের কথা বলে একই উপজেলার হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রাজীব আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় জয়নব কোচিং করার সুযোগ পাননি। কিন্তু অদম্য ইচ্ছার কারণে বাসায় থেকে নিজেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন৷ ঢাকায় কোচিং করা কয়েকজন সহপাঠীর কাছ থেকে নোট সংগ্রহ করে পড়াশোনা করে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন।
প্রতিবেশী শিহাব খান বলেন, জয়নব খুবই মেধাবী ছিলেন। অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। তার পরিবার তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখত। দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুতে পরিবার খুবই ভেঙে পড়েছে।
জয়নবের মা বলেন, আহারে আমার মাকে শীতের পিঠা খাওয়াতে পারলাম না। আমাদের আশা ছিল মেয়েটি শিক্ষিত হয়ে বড় অফিসার হবে। কিন্তু আল্লাহ আমাদের সব স্বপ্ন-আশা ভেঙে চুরমার করে দিল।
জয়নব খাতুনের বড় ভাই মেহেদী হাসান বলেন, এইচএসসির পর আর পড়াশোনা করেননি তিনি। টুকটাক কাজ করেন। তাঁর এক বোনের বিয়ে হয়েছে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন জয়নব। জয়নবই পরিবারের একমাত্র সদস্য, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
মেহেদী হাসান বলেন, ‘পরিবারের অবস্থা ভালো না। এরপরও নিজেদের খরচ বাঁচাইয়্যা বোনরে টাকা পাঠাইতাম। সবাই চাইতাম জয়নব ভালো থাকুক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর জয়নব টিউশনি করতে চাইছিল। বলছি, তুই পড়। টাকার ব্যবস্থা আমরা করব।’
মেহেদী আরও বলেন, ‘এবারের ঘোরা শেষ করে পড়াশোনায় মন দেবে, বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবে— এমনই কথা দিয়েছিল জয়নব। তবে এখন তো সব স্বপ্নই শেষ। টাকা শেষ হয়ে গেলে এখন আর কেউ বলবে না ভাইয়া টাকা পাঠাও। বোন বিসিএস দিয়ে বড় কর্মকর্তা হইছে, সে স্বপ্নও শেষ। বলতে গেলে সবার স্বপ্নই শেষ হইয়্যা গেল।’