আগস্ট ১৪, ২০২২, ০৪:৫৪ পিএম
‘আমরা তো ঢোল হয়ে গেছি, ফুটবল হয়ে গেছি। বলের মতো সবাই আমাদের লাথি মারে, সবার লাথি খাওয়ার তালেই থাকি। কোনো জিনিসের দাম তো কম না, সব বাড়তেয়াছে। কি খামু? সারা মাস চলার লাইগা হস্তা সবজি খাই। মাছ, মাংসের ধারের কাছেও যাইতে পারি না। হোটেলে কাজ কইরা যা পাই তাই দিয়া সারা মাস চলন লাগে। চিন্তা হয় খুব। বয়স এখন ষাইটের কাছাকাছি। বাঁচতে পারমু তো!’ রবিবার সকাল বেলা কারওয়ান বাজারে কাঁচাবাজার করতে এসে এমন আক্ষেপ করছিলেন রহিম শিকদার।
এমনই আরেকজন দিন মজুর জসিম শেখ। তিনিও এসেছেন ওই বাজারে প্রতিদিনের বাজার করতে। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে তিনি বললেন, সারারাত কাম কইরা ৫০০ টাকা পাই। হেই টাকা দিয়া বাজার করি চার জনের সংসার আমার। এই টাকায় কী কিনমু আর কী বাঁচামু। আমরা বড়রা তিন বেলার জায়গায় এহন দুই বেলা খাই। তয় আমার একটা ছোট বাচ্চা আছে, হেরে তো না খাওয়াই রাখতে পারি না। কিন্তু আমার তো কুলায় না এহন।
শুধু নিম্নবিত্তরাই নয়, নিত্যপণ্যের আগুনের আঁচ লেগেছে মধ্যবিত্তদের গায়েও। এরকম এক বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা বললেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বললেন বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে। উনি কি বাজারে আসেন? একবার বাজারে আসলে তিনি বুঝতে পারতেন যে আমরা কোন বেহেশতে বসবাস করছি।
মাসিক বাজার করতে আসা এক ক্রেতা বললেন, ছয় হাজার টাকা সাথে নিয়ে এসেছি। বাসা থেকে বলে দিয়েছে, ২৫০০ টাকার মধ্যে মুরগি নিতে। কিন্তু মুরগিতেই পড়ে গেছে ৩৩০০ টাকা। এদিকে কিন্তু আমাকে বাকি মাসটা এই ৬০০০ টাকার মধ্যেই শেষ করতে হবে, তাহলে কীভাবে সম্ভব?
প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। টালমাটাল বাজারে স্বস্তিতে নেই সাধারন মানুষজন। সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের পণ্যের দামই বাড়তি। রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়ে।
ব্রয়লার মুরগিও এখন নাগালের বাহিরে
বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি করছেন ২০০ টাকা। তবে কোনো কোনো ব্যবসায়ী ১৯০ টাকা কেজিতেও বিক্রি করছেন। অথচ গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকার মধ্যে।
ব্রয়লার মুরগির পাশাপাশি দাম বেড়েছে পাকিস্তানি কক বা সোনালি মুরগিরও। সোনালি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ২৮০ টাকা। তবে দেশী মুরগি আগের দামেই এখনও বিক্রি হচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম বৃদ্ধি নিয়ে কথা হয় মুরগি ব্যবসায়ী কাকনের সাথে। তিনি বললেন, সবকিছুর দাম বেড়েছে। পোল্ট্রির খাবার থেকে পরিবহন ব্যয়- সবখানে মূল্যবৃদ্ধি। আমরা বেশি দামে কিনি তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। না হলে তো আমাদের লাভ থাকে না।
ডিমও নেই সস্তার তালিকায়
ব্রয়লার মুরগির পাশাপাশি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম। প্রথমবারের মতো ফার্মের মুরগির এক ডজন ডিমের দাম ১৫০ টাকা ছাড়াল। আর মুদি দোকানে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩ টাকা। এক সপ্তাহ আগে ডিমের ডজন ছিল ১২০ থেকে ১২৫ টাকা।
কারওয়ান বাজারের ডিম ব্যবসায়ী জুয়েল তালুকদার বললেন, গত ২০ বছরের মধ্যে চলমান সময়ে ডিমের দাম ইতিহাস ভাঙছে । এখন একটা ডিম পাইকারি তে বিক্রি করি সাড়ে ১২ টাকা। অর্থাৎ খুচরা বাজারে এক একটা ডিমের দাম ১৫ টাকা।
মালিবাগের ব্যবসায়ী এস এম সুমন আহমেদ বললেন, গত সপ্তাহে এক ডজন লাল ডিম ১২৫ টাকায় বিক্রি করেছি। তেলের দাম বাড়ানোর পর গত কয়েকদিন হুটহাট ডিমের দামও বেড়েছে। এখন এক ডজন ডিম ১৪৫ টাকা বিক্রি করছি। আমি ১০-১৫ বছর ধরে ডিমের ব্যবসা করছি। এর আগে কখনো ডিম এতো দামে বিক্রি করিনি।
ডিম কিনতে আসা এক ক্রেতা জানান, সবকিছু যখন নাগালের বাইরে চলে গেছে তখন আমরা ডিম ডাল খেয়ে দিন পার করেছি। এখন ডিমের দামও বেড়ে যাওয়ায় ভাবতে হচ্ছে যে বাকি দিনগুলো কীভাবে চলবে।
চাহিদা কম দাম বেশি মাছের
বিভিন্ন বাজারের মাছ ব্যবসায়ীরা জানালেন, রুই মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৪৫০ টাকা। তেলাপিয়া, পাঙাস মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৯০ টাকা। শিং মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৬০ টাকা। কৈ মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। পাবদা মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে এসব মাছের দামে কেজিতে ১০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
দাম বাড়ানোর তালিকায় যোগ দিয়েছে মাছের রাজা ইলিশও। এক কেজি ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা। ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। আর ৪০০-৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা।
কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী নুরু মিয়া বললেন, পাইকারি বাজার থেকে আনতে গেলে আমাদের কেনা দাম বেশি পড়ছে, সেটার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারগুলোতে। কিছু দিন আগেও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি করেছি ১৬০ টাকায় এখন এটার দাম ২২০ টাকা। কই মাছ ১৬০-১৮০ টাকায় বিক্রি করেছি, বর্তমান বাজারে দাম ২৪০ টাকা।
সবজিতে নেই স্বস্তি
চাকুরীজীবী সজীব উদদৌলা বললেন, মাছ-মাংস খাওয়াতো কবেই ছেড়েছি। যা-ও সবজি দিয়ে খাব সে সবজির দামও দিন দিন এমনভাবে বাড়ছে যে এখন আর উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।
ব্যবসায়ীরা বললেন, বাজারে সব থেকে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে শিম। ২৫০ গ্রাম শিম বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। তবে কেউ এক কেজি কিনলে ১৯০ টাকা রাখা হচ্ছে। গত সপ্তাহে ২৫০ গ্রাম শিম বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকায়।
শিমের পাশাপাশি দাম বেড়েছে পাকা টমেটোর। গত সপ্তাহে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পাকা টমেটো এখন ১০০ থেকে ১৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর গাজর গত সপ্তাহের মতো ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। বরবটিও গত সপ্তাহের মতো ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে শসা দিয়েছে দ্বিগুন লাফ। গত সপ্তাহে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজির শশার দাম বেড়ে এখন হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা।
এছাড়া বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা, কাঁকরোলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা, কাঁচা পেঁপের কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা, পটল ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। কচুর লতি, ঝিঙে, চিচিঙ্গার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। করলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে এসব সবজির দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
তেলে অসহায় ক্রেতারা
কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, গত দু-এক দিনে লিটারে ২০ টাকা বেড়ে পাম আর খোলা সয়াবিনের দাম আবার ঠেকেছে ১৪৫ আর ১৭০ টাকায়।
চালের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত
এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে চালের দাম কেজি প্রতি ৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৬ টাকা, আর চিকন চালের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা পর্যন্ত। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজিতে। আর মাঝারি মানের মোটা পাজাম কিংবা স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৭ থেকে ৫৮ টাকা কেজিতে।
আর ২৮ ও ২৯ জাতীয় চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজিতে। মিনিকেট ৭০ থেকে ৭৪ এবং নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১৫ টাকা করে। এ ছাড়া সব ধরনের পোলাও চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা।
তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, তেলের দাম বাড়ার কারণে উত্তরের জেলাগুলো থেকে চালবহনকারী প্রতিটি ট্রাকের ভাড়া বেড়ছে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। কিন্তু সে অনুযায়ী প্রতি বস্তা চালে দাম বাড়ার কথা ৫০ টাকারও কম। কিন্তু তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতিদিনই বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা ক’রে বাড়িয়ে দিচ্ছেন মিল মালিকেরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেভাবে প্রতিনিয়ত নিত্য পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে এতে করে দেশের মানুষ খুব শীঘ্রই অপুষ্টিজনিত নানা রোগে ভুগবে। সুষম খাদ্যের অভাবে দেশের দুই কোটিরও বেশি মানুষ এরমধ্যেই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। এর ওপর মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, ঘিসহ ভোজ্যতেলের অগ্নিমূল্য এবং মানুষের আয় কমে যাওয়ায় এরই মধ্যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের সুষম খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ দুই উপাদান প্রোটিন ও ফ্যাট গ্রহণের সক্ষমতা কমেছে। চলমান আর্থিক সংকটের কারণে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী নতুন করে অপুষ্টিজনিত নানা রোগের দিকে ঝুঁকবে।