আনারসের নাম 'জলঢুপি'। উচ্চারণের তারতম্যে স্থানীয়রা একে 'জলডুবি' বা ‘জলডুগি’ও বলে থাকে। সুঘ্রাণযুক্ত রসে ভরপুর এ আনারস খেতে স্বাদ যেন মন হরণ করে নেয়।
এ জাতের আনারসের আদিবাড়ী মেঘালয় হলেও সময়ের পরিক্রমায় মধুপুরের গড় অঞ্চলে বসতি গড়েছে। পুরো মধুপুর জুড়েই পাহাড়ি গড় ও শালবন এলাকার অভ্যন্তরে উঁচুনিচু ও সমতল দুই রকমের জমিতেই আনারসের প্রচুর চাষ হয়। এ অঞ্চলের ফুলবাগচালা ইউনিয়নের আগামারী, বাগাডোবা, অরুণখোলা, ষোলাকুঁড়ি ও আউশনাড়া ইউনিয়নে আনারসের সবচেয়ে বেশি চাষ হয়।
ওজন: সাইজভেদে ছোট ২-৩শ গ্রাম, মাঝারি ৪-৫শ গ্রাম ও আকারে একটু বড় ৬-৭ শ গ্রাম হয়ে থাকে।
পুষ্টিগুণ: কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, পাকা আনারসে গড়ে শতকরা ১০ ভাগ চিনি, ১ ভাগ সাইট্রিক এসিড থাকে। টাটকা আনারসের মধ্যে প্রোটিন জাতীয় খাদ্যে পরিপাক ও হজমের সহায়ক ব্রোমিলিন নামক জারকরস থাকে। কাশি ও ঠান্ডাজ্বর নিরাময়ে আনারসের সুখ্যাতি আছে। এছাড়া আনারসের পাতা থেকে মোম ও সুতা তৈরি হয়।
ফলের রাণী আনারস
আম যদি ফলের রাজা তেমনি আনারসকে ফলের রানী বললে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। কেননা মাথায় মুকুট পরে কাঁটার আসনে বসে গাম্ভীর্যের সাথে আনারস গর্বিত জীবন যাপন করে। তাছাড়া, চেহারা, রূপ-লাবণ্য সব মিলিয়ে আনারসই ফলের রানী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। কাব্যরসিকরা অবশ্য আনারসকে স্বর্ণকুমারীও বলে থাকেন।
গবেষকদের ধারণা আনারসের উৎপত্তিস্থল ব্রাজিলে। আনারস উৎপাদনে প্রধান দেশগুলোর মধ্যে আছে- কোস্টারিকা, ব্রাজিল, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত।
ধারণা করা হয়, ১৫৪৮ সালের দিকে আমাদের এ অঞ্চলে আনারস এসেছে। পাকা আনারসের অম্ল মধুর রসালো মিষ্টি গন্ধ হৃদয় ছুঁয়ে যায়, খাওয়ার প্রতি লোভ বাড়িয়ে দেয়।
আনারসের জুস, স্লাইস, এসিড, স্কোয়াশ, সিরাপ, জ্যাম, জেলি, আনারস সত্ত্ব, ভিনেগার, সাইট্রিক এসিড, ক্যালসিয়াম সাইট্রেট, অ্যালকোহল বিশ্বনন্দিত।
আনারসের বাগান
আনারসের বাগানে গেলে এক অদ্ভূত রোমাঞ্চকর অনুভূতির জন্ম নেয়। মুহূর্তের জন্য সব ভুলে মনে হয় এখানেই থেকে যাই। আর মনে হয় পাকা আনারস বাগান থেকে তুলে খাওয়ার আনন্দ ও মজাই বুঝি আলাদা, অতুলনীয়।
আনারসের হাট
গারো বাজার, ২৫ মাইল ও জলছত্র আনারসের বড় হাট। বুধ ও শুক্রবারে হাট বসলেও মৌসুম চলাকালে প্রতিদিন এ বাজারে আনারস পাইকারি কিনতে ব্যবসায়ীরা ছুটে যায়। কেউ বাইসাইকেলে ঝুলিয়ে, কেউ ঘোড়ার গাড়িতে, কেউ পিকআপ ভ্যানে করে ঠেলে-ঠুলে নিয়ে আসছে আনারস।
তবে এখন মধ্যস্বত্বভোগীরা আনারস বাগান থেকেই কিনে নিয়ে আসে। ট্রাক ভরে পাইকাররা ও সাইকেলে চেপে খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা বাগানমালিকের সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ করে নেয়।
চাষ ও ফলনের সময়
চৈত্র-বৈশাখ মাস থেকেই 'জলঢুপি' আনারস পাকতে শুরু করে। এ সময় থেকেই বাজারেও পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য বড় জাতের আনারস পাকার মৌসুম হলো আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শ্রাবণের শেষান্তে। তবে এ অঞ্চলে সারাবছরই অল্প-স্বল্প আনারস বাজারে পাওয়া যায়।
মধুপুরে আনারস আবাদের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। গড় (উঁচু) এলাকার আউশনারা ইউনিয়নের ভেরেনা সাংমা ষাটের দশকের শেষ দিকে গিয়েছিলেন ভারতের মেঘালয়ে। সেখানে প্রচুর আনারস হয়। তিনি কয়েকটি জায়ান্টকিউ জাতের আনারসের চারা নিয়ে আসেন। মধুপুর গড়ে নিয়ে এসে রোপণ করেন। প্রমবারেই ভালো ফলন হয়। খেতেও সুস্বাদু ছিল। পরে আরও বেশি জমিতে আনারস আবাদ করেন। তার দেখাদেখি অন্যরাও আনারসের আবাদ করতে থাকে।
একদিন দেখা গেল মধুপুরের সব দিকে আনারস। মূলত জায়ান্টকিউই আবাদ হতো, তবে গত কয়েক বছর জলঢুপিও হচ্ছে। পাবর্ত্য অঞ্চলের আনারস জায়ান্টকিউ। জায়ান্ট মানে দৈত্য। জায়ান্টকিউ আকারে সত্যিই বড়। এদিকে জলডুপিও খেতে মিষ্টি তবে আকারে ছোট।
মধুপুর অঞ্চলে জলঢুপি আনারস ছাড়াও এ অঞ্চলে চাষ হয় বড় আকৃতির ক্যালেন্ডার, জায়ান্টকিউ ও হানিকুইন প্রজাতির আনারস।
এছাড়াও সিলেট, রাঙামাটি ও নরসিংদী অঞ্চলে 'জলঢুপি'র একই প্রজাতির ছোট ও রসালো স্বাদযুক্ত আনারসের চাষ হয়ে থাকে।
কীভাবে যাবেন আর থাকবেন কোথায়
ঢাকা থেকে মধুপুর যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম সড়কপথ। ঢাকার মহাখালী বাস স্টেশন থেকে যেকোনো বাসে চড়ে সহজেই মধুপুর যাওয়া যায়। পুরো মধুপুর ঘুরে বেড়াতে হলে একদিনে সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে থাকার জন্য আবাসিক হোটেল ও পূর্বানুমতি নিয়ে বনবিভাগের কোনো বিশ্রামাগারে থাকতে পারলে আপনার ভ্রমণ পরিপূর্ণ হবে।
জাতীয় এ উদ্যানের ভেতরে জলই, মহুয়া, বকুল, চুনিয়া কটেজ ছাড়াও দোখালা বন বিশ্রামাগারে রাত যাপন করা যায়। সেক্ষেত্রে বনকর্মকর্তাদের সাথে আগেভাগে যোগাযোগ করে নিলে ভালো। বনের ভিতর রাত্রিযাপন যেন সৌন্দর্য উপভোগের আরেক রাজ্যে পরিভ্রমণ।