নভেম্বর ১৫, ২০২২, ০৯:১৫ পিএম
সৌদি আরবে থাকা তিন লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে দেশটির সরকার। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশিও রয়েছে। এক দিকে সৌদি আরবে বাংলাদেশের বিশাল শ্রমবাজার, অন্যদিকে সবাইকে পাসপোর্ট দিলে তখন তাঁদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রশ্নও উঠতে পারে। এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সংকটে থাকা বাংলাদেশের জন্য। এমনটাই মনে করছে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁরা আরও বলছেন, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়ার সৌদি আরবের এই অনুরোধ মোটেও বন্ধুসুলভ নয়।
সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে বৈঠক করেন সৌদি স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী ড. নাসের বিন আব্দুল আজিজ আল দাউদ। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি সৌদি আরবে অবৈধভবে বসবাসরত তিন লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার অনুরোধ জানান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবে মোট তিন লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে যাদের মধ্যে ৬০ হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশি পাসপোর্ট আছে। বাংলাদেশ সরকার এসব পাসপোর্ট নবায়ন করছিল না। সৌদি সরকার চাচ্ছে ওই ৬০ হাজারের পাশাপাশি অন্যদেরও অর্থাৎ পুরো ৩ লাখ রোহিঙ্গাকেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট যেন দেওয়া হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, সৌদিতে থাকা সব রোহিঙ্গার বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যদি এই চাপে নতি স্বীকার করে তাহলে বাংলাদেশকে আরও তিন লাখ রোহিঙ্গাকে বরণ করে নিতে হবে। আর এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ দূত ওয়ালিউর রহমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়ার অর্থই হলো তাঁদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া। সৌদি আরবে অবস্থান শেষে বা চাকরির মেয়াদ শেষে ওইসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে চাইলে তাঁদের বাধা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।’
পেশাদার এই কূটনীতিক আরও বলেন, ‘সৌদি আরবে থাকা সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার অনুরোধ মোটেও বন্ধুসুলভ নয়। সৌদি আরব বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র। দেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার হিসেবে পরিচিত ওই দেশটিতে ২২ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কাজ করছেন। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে যখন জোরালো তৎপরতা চালাচ্ছে, এমন সময় বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার সৌদি অনুরোধ মোটেও দেশের জন্য সুখকর নয়। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ‘সংকট’শুরু যেভাবে
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত মোট পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ওই সময় সৌদি আরব ৫ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়। এর মধ্যে পাকিস্তানি পাসপোর্টে সৌদিতে যায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা। অন্য আড়াই লাখ যায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে। পাকিস্তান সরকার পাসপোর্ট দিলেও নাগরিকত্বের ঘরে ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ শব্দটি উল্লেখ করে। অন্যদিকে, বাংলাদেশি পাসপোর্টে তাঁদের নাগরিকত্ব সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এ অবস্থায় ওইসব রোহিঙ্গার বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে চিহিৃত করেছে সৌদি প্রশাসন। আর তাই সৌদি সরকারের দাবি, তাঁরা যেহেতু বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে গেছে, তাই তাঁরা বাংলাদেশি এবং এসব রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন করতে হবে।
পাসপোর্ট নবায়ন প্রশ্নে কেন বারবার চাপ দিচ্ছে?
সৌদি আরব এর আগেও একাধিকবার রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়নের প্রশ্ন তুলেছিল। ২০১০ সাল থেকে তাঁরা মূলত এই পাসপোর্ট নবায়নের জন্য চাপ দিচ্ছে। করোনার আগে তাঁরা ৫৪ হাজার জনকে পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য বলেছিলো। এখন সেই সংখ্যা বাড়িয়ে তাঁরা বলছে তিন লাখ।
সৌদি আরবের মক্কায় বসবাসরত এক রোহিঙ্গা শরণার্থী। ছবি: প্রেস টিভি
চলতি বছরের প্রথম দিকেই একই প্রশ্ন তোলে সৌদি সরকার। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ওদের যদি আগে কখনও বাংলাদেশের পাসপোর্ট থাকে কিংবা যদি কোন প্রমাণ দেখাতে পারে, তাহলে আমরা অবশ্যই তাঁদের পাসপোর্ট ইস্যু করবো। অন্যথায় আমরা কীভাবে করি? তখন তাঁরা বলেছে, পাসপোর্ট ইস্যুর অর্থ এই নয় যে আমরা তাঁদের তোমাদের দেশে বিতাড়িত করবো।
সৌদি আরব রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন কেন করতে চায় —এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আমেনা মহসিন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সমস্যায় রয়েছে সৌদি আরব। এ অবস্থায় তাঁরা আর এই রোহিঙ্গাদের বোঝা বহন করতে চাইছে না। তাছাড়া সৌদিতে থাকা রোহিঙ্গারা নানা অপরাধেও জড়িয়ে পড়েছেন। পাসপোর্ট দিতে পারলে এই অজুহাতে তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারে।
উভয় সংকটে সরকার
রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন প্রশ্নে সৌদি আরবের অনুরোধে উভয় সংকটে পড়েছে সরকার। সাবেক পররাষ্ট্র সচব মো. শহীদুল হক দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়ার অনুরোধ অযৌক্তি অনুরোধ। এর জন্য সরকার উভয় সংকটে পড়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ, একদিকে সৌদি আরবে বাংলাদেশের বিশাল শ্রমবাজার রয়েছে। অনুরোধ না রাখলে এই বিশাল বাজার হারানোর শঙ্কা রয়েছে।’
সাবেক এই সচিব আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিলে তাঁদের বাংলাদেশি হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এমনিতেই প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বংলাদেশে রয়েছে। তারপর আবার সৌদিতে থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হলে যোগ হতে পারে আরও তিন লাখ।’ বিষয়টি নিয়ে সরকারকে সতর্কভাবে এগোনোরও পরামর্শ দেন সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘সৌদি আরব বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের এককভাবে সবচেয়ে বড় উৎস। সেখানে এখন কমবেশি ২৮ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত। সৌদি সরকার তিন লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে এটাকে কাজে লাগাতে পারে।’ তাঁরা যে বাংলাদেশের নাগরিক নয়, এটা লিগ্যালি ভেরিফিকেশন প্রসেসের মাধ্যমে প্রমাণের জন্য সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি।
তবে রোহিঙ্গা ইস্যু সৌদিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব অনুরোধ জানালেও বংলাদেশকে তাতে সাড়া দেওয়া যাবে না। সৌদি আরবকে ভালভাবে বুঝাতে হবে যে তাঁরা মিয়ানমারের নাগরিক, বাংলাদেশের নয়। পাঠাতে হলে মিয়ানমারে পাঠান। ওই দেশের সরকারকে চাপ দেন।’ তবে এতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার হারানোর কোনো শংকা নেই বলেও তিনি মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁরা জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিতে মিশরে অবস্থান করায় সেই মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত এসসা ইউসেফ এসসা আল দুহাইলানের সাথেও যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।