অক্টোবর ১০, ২০২৫, ০১:৫৫ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কারিগরি অনুবিভাগের উদ্যোগে ৬০০ গ্রেড রিবারের ব্যয়-সাশ্রয়ী ব্যবহার ও কাস্টমাইজড সমাধান’ শীর্ষক একটি টেকনিক্যাল সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর, ২০২৫, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) সম্মেলন কক্ষে এ সেমিনারে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ৬০০ গ্রেড রিবারের ব্যবহার, এর অর্থনৈতিক সুবিধা এবং বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণে এর সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সেতু বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক, মোহাম্মদ আবদুর রউফ। কী-নোট বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রাক্তন অধ্যাপক ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ ড. এম. শামিম জেড বসুনিয়া। এছাড়াও, অনুষ্ঠানটিতে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. রাকিব আহসান তার ‘ইনহ্যাঞ্চিং ইকোনমি অ্যান্ড সাসটেইনেবলিটি থ্রু হাই-স্ট্রেন্থ রিইনফর্সমেন্ট ইন লার্জ স্কেল কংক্রিট স্ট্রাকচার’ শীর্ষক একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, বিবিএ-এর কারিগরি অনুবিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী মোঃ ফেরদাউসসহ অন্যান্য প্রকল্প পরিচালক, প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাবৃন্দ।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. রাকিব আহসান বলেন, উচ্চ শক্তিসম্পন্ন রড (হাই স্ট্রেন্থ রিইনফোর্সমেন্ট) যেমন- ৬০০ গ্রেড ব্যবহার করলে বৃহৎ কংক্রিট কাঠামোয় প্রয়োজনীয় রডের পরিমাণ কমে যায়, অথচ কাঠামোর ভারবহন ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে একদিকে নির্মাণ ব্যয় হ্রাস পায়, অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব সমাধান নিশ্চিত হয় কারণ কম ইস্পাত ব্যবহার করেই টেকসই কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হয়। তার গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, প্রচলিত রডের তুলনায় ৬০০ গ্রেডের রড ব্যবহারে ১০-২৫% পর্যন্ত রিবার সাশ্রয় সম্ভব, যা নির্মাণ খরচ কমাতে সহায়ক। একইসাথে উচ্চ শক্তির কারণে কংক্রিটের পরিমাণও তুলনামূলকভাবে কম লাগে, যা পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ড. রাকিব আহসান জোর দিয়ে বলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণে এই ধরনের হাই স্ট্রেন্থ রডের ব্যবহার হলে টেকসই উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সাশ্রয় এবং দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। একইসাথে এটি হবে বাংলাদেশের নির্মাণশিল্পে এক নতুন দিগন্ত।
প্রধান অতিথি, সেতু বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক, মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, “আমাদের দেশের সেতু ও অবকাঠামো প্রকল্পগুলো দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। এসব প্রকল্পে টেকসই সমাধান এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের এমন রিবার ব্যবহার করতে হবে যা শুধু ব্যয় সাশ্রয়ী নয়, বরং এর উচ্চ শক্তি এবং স্থায়িত্ব দীর্ঘমেয়াদে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমিয়ে আনবে। এর ফলে সরকারি অর্থ সাশ্রয় হবে এবং জনগণ আরও নিরাপদ অবকাঠামো উপভোগ করতে পারবে বলে আমি আশা করি।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রাক্তন অধ্যাপক ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ ড. এম. শামিম জেড বসুনিয়া বলেন, “বাংলাদেশ এখন একের পর এক মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পে আন্তর্জাতিক মানের উপকরণ ব্যবহার না করলে কাঠামোগত ঝুঁকি থেকে যাবে। ৬০০ গ্রেড রিবার তার উন্নত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে কাঠামোর টেকসই শক্তি নিশ্চিত করতে পারে। এর ফলে প্রকল্পগুলোর আয়ুষ্কাল বাড়বে এবং দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম আরও নির্ভরযোগ্য হবে।”
অভিজ্ঞ স্টিল ইন্ডাস্ট্রি পেশাজীবী ও মেটালার্জিস্ট ইঞ্জি. মো. সাইফুল ইসলাম, তার প্রেজেন্টেশনে উল্লেখ করেছেন যে এশিয়ায় প্রথম কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (EAF), যা জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড দ্বারা ইনস্টল করা হয়েছে, এটি বিশ্বের গবেষণাভিত্তিক দেশ ও শীর্ষস্থানীয় স্টিল নির্মাতাদের দ্বারা গ্রহণ করা সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ও উন্নত প্রযুক্তির স্টিলমেকিং প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি। তিনি জানান, অত্যাধুনিক কোয়ালিটি কন্ট্রোলের কারণে, ৬০০ এমপিএ গ্রেড সহ উচ্চ শক্তির রড উৎপাদন করা অত্যন্ত সহজ এবং ধারাবাহিক মান নিশ্চিত করা সম্ভব।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে আন্তর্জাতিক রিবার স্টিলমেকিং স্ট্যান্ডার্ডসমূহ যেমন চীন, কানাডা, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রড উৎপাদনের জন্য ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (EAF) সহ বেসিক অক্সিজেন ফার্নেস (BOF) বা ওপেন-হার্থ ফার্নেস (OHF) ব্যবহারের সুপারিশ করে, কিন্তু ইনডাকশন ফার্নেস (IF) অনুমোদিত নয়। তবে বাংলাদেশে এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে, অধিকাংশ নির্মাতা এখনও ইনডাকশন ফার্নেস ব্যবহার করে, যা অনেক দেশে দুর্বল মান ও টেকসইতা সমস্যা জনিত কারণে বাতিল করার পরিকল্পনা করা হয়েছে বা হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে, তিনি থাইল্যান্ড উল্লেখ করেছেন, যেখানে ব্যাংকক ভূমিকম্প ও ভবন ধসের পর, শিল্প মন্ত্রণালয় সব ইনডাকশন ফার্নেস-ভিত্তিক স্টিল উৎপাদন ইউনিট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কারণ এগুলোর মান ধারাবাহিক এবং টেকসই নয়। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে ভারতের রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজ ডিপার্টমেন্টের সার্কুলার অনুযায়ী, রডের টেস্ট সার্টিফিকেটে উৎপাদন প্রক্রিয়ার ধরণ উল্লেখ থাকাটা বাধ্যতামূলক।
ইঞ্জি. সাইফুল আশা প্রকাশ করেছেন যে বাংলাদেশ ব্রিজ অথরিটি (BBA) রড ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করবে, যাতে দেশের স্টিলমেকিং ও নির্মানের ক্ষেত্রে মান, নিরাপত্তা ও টেকসইতার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ৬০০ গ্রেড রিবার হলো আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি উচ্চ শক্তির রড, যা প্রচলিত রডের তুলনায় অধিক স্থায়িত্ব, নমনীয়তা এবং ভারবহন ক্ষমতা প্রদান করে। এর ব্যবহার কংক্রিট কাঠামোর শক্তি বৃদ্ধি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমায়। একইসাথে এটি নির্মাণ ব্যয় হ্রাস ও পরিবেশবান্ধব সমাধান নিশ্চিত করতে সক্ষম।
গোলটেবিল আলোচনায় সেতু বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি কর্মকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদরা অংশগ্রহণ করেন। বক্তারা মনে করেন, বাংলাদেশে বৃহৎ প্রকল্পে হাই স্ট্রেন্থ ৬০০ গ্রেডের রিবার ব্যবহার অবকাঠামো উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।