নেতাদের চাপে নিয়ম ভেঙে ডাকসুতে এসি বসাচ্ছেন ভিসি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ৮, ২০২৫, ১২:০৯ পিএম

নেতাদের চাপে নিয়ম ভেঙে ডাকসুতে এসি বসাচ্ছেন ভিসি

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাজেট ঘাটতি থাকলেও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনে ৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ৯টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র (এসি) বসানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অফিস ছাড়া অন্য কোথাও এসি দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও উপাচার্য (ভিসি) ডাকসু নেতাদের চাপে এগুলো বসানোর অনুমোদন দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সিদ্ধান্তকে অনিয়ম বলছেন কোষাধ্যক্ষ। অন্যদিকে কেনার ক্ষেত্রেও নিয়ম মানা হয়নি। জরুরি পণ্য দেখিয়ে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এসি কেনা হচ্ছে।

‘ডাকসু নেতাদের জন্য নিয়ম ভেঙে এসি বসাচ্ছেন ভিসি’ শিরোনামে সমকালের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।

এতে বলা হয়, গত সপ্তাহে রাজস্ব বাজেট থেকে এসি বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়। তখন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বিদেশে থাকায় কোষাধ্যক্ষের রুটিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ। গত ১ সেপ্টেম্বর কোষাধ্যক্ষ দেশে ফিরেছেন। 

ঘাটতি বাজেটে চলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সেন্টারগুলোতে পর্যাপ্ত অর্থ দেওয়া যাচ্ছে না। আবাসন সংকট, শ্রেণিকক্ষ সংকট আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম কর্মরত শিক্ষার্থীদের নামমাত্র সম্মানিও প্রশাসন দিতে পারছে না। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রথমবার অনুমতি না দিলেও ডাকসুর ভিপি আবু সাদিক কায়েম বারবার ফোন করে চাপ সৃষ্টি করায় ফের ফাইল এনে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ এসি বসানোর অনুমোদন দেন। 

গত সোমবার নিজ কার্যালয়ে কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, ‘আমি ছুটিতে থাকা অবস্থায় এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। খোঁজ নাও কোন এখতিয়ারে, কোন নিয়মে এটি অনুমতি দেওয়া হয়েছে– আমি জানি না। আমি থাকলে অবশ্যই প্রশ্ন তুলতাম, এটা হওয়ার কথা না। কেন দেওয়া হচ্ছে সেটার ব্যাখ্যা চাইতাম। সব কিছু একটি জবাবদিহির মধ্যে থাকা উচিত।’ 

জানতে চাইলে অধ্যাপক মামুন আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘আমি রুটিন দায়িত্বের অংশ হিসেবে উপাচার্যের কাছে ফাইলটি ফরোয়ার্ড করেছি। আমি অনুমোদন করিনি, উপাচার্য অনুমোদন করেছেন। যদি এটা আমার রুটিন দায়িত্ব না হতো, আমি অবশ্যই বিষয়টি কুয়েরি দিতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সংকটের মধ্যে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য আমি উদার হতে রাজি আছি। কিন্তু কোনো ফ্যান্সি (আলংকারিক) কিছু দিতে হয়, এসি দিলে সে সুন্দর করে ঘুমাতে পারবে, এখানে আমি উদার হতে পারব না। কারণ আমি শিক্ষার্থীর মৌলিক চাহিদা ঠিকঠাক পূরণ করতে পারছি না। তোমাকে কীভাবে দেব? বিষয়টি আরও ক্লোজলি দেখা দরকার ছিল।’ 

সরকারি ক্রয় বিধিমালার (পিপিআর) ৯৭ ধারা অনুযায়ী, দুর্লভ পণ্য, জরুরি পণ্যের ক্ষেত্রে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি (ডিপিএম) অনুসরণ করার কথা। জরুরি না হলে সাধারণত উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেনার নিয়ম। এ ক্ষেত্রে সেটাও লঙ্ঘন হয়েছে। 

প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তা (বিদ্যুৎ) আমিনুল ইসলাম বলেন, “ডাকসু থেকে চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন অনুমোদন দেওয়ায় তারা এসি বসানোর কাজ করছেন। ‘গ্রি’ কোম্পানির মোট ৯টি এসি বসানো হচ্ছে। সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করায় দ্রুতই এসিগুলো বসানো হবে।”

এর আগে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনের পর এসি লাগানোর চেষ্টা করলেও প্রশাসন অনুমতি দেয়নি। পরে ডাকসুর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক (জিএস) গোলাম রাব্বানী স্পন্সরের মাধ্যমে নিজ কক্ষে এসি লাগালে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হয়। এক পর্যায়ে এসি খুলে নেওয়া হয়। 

চলতি বাজেটে ডাকসুর জন্য মোট ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানান হিসাব পরিচালক সাইফুল ইসলাম। প্রকৌশল দপ্তর থেকে জানা গেছে, এর মধ্যে ডাকসু ভবনের সংস্কার এবং সৌন্দর্য বর্ধনে এখন পর্যন্ত ২৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আরও বেশ কিছু সংস্কারকাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি এসি বাবদ ৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা, সাউন্ড সিস্টেমের জন্য ৭১ হাজার টাকা, পানির ফিল্টারে ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়েছে। 

নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) মোহাম্মদ ইব্রাহিম জানান, কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে ডাকসু ভবনে আসবাব ও পর্দায় চার লাখ টাকা, নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা শৌচাগার নির্মাণে সাড়ে তিন লাখ, নতুন ওয়ার্ক স্টেশন তৈরিতে দুই লাখ ৭০ হাজার, কক্ষ সংস্কার এবং রং করাতে দুই লাখ ৫২ হাজার, সাইনবোর্ড রং করা, ক্রোকারিজ, আসবাবে ৮৩ হাজার টাকার কাজ হচ্ছে। সবগুলো কাজ ডিপিএম পদ্ধতিতে করা হচ্ছে। এ ছাড়া ডাকসুতে নামাজঘর নির্মাণের একটি প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। 

ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক এইচ এম মোশারফ হোসেন বলেন, ‘সরাসরি ডাকসু নেতারা প্রশাসনের কাছে এসি চেয়েছেন, প্রশাসন বরাদ্দ দিয়েছে। সরাসরি হয়েছে, আমার মাধ্যমে এটি হয়নি।’ 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত সোমবার উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান সমকালকে বলেন, তিনি এ ক্ষেত্রে কী নিয়ম রয়েছে সেটা জেনে ব্যবস্থা নেবেন। তিনি বলেন, ‘আমি এটা খোঁজ নেব, এটা কীভাবে হয়েছে। খবর নিয়ে দেখব যে, এসি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধিকারের কোনো ব্যাপার যদি থাকে, আমাকে দেখতে হবে।’

এদিকে ডাকসুর ভিপি আবু সাদিক কায়েম চাপ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘ডাকসুতে বসার অবস্থা ছিল না। আমরা শুধু দ্রুত একটা ওয়ার্কিং এনভায়রনমেন্ট তৈরির ব্যাপারে বলেছিলাম। এসির বিষয়ে আলাদা কিছু বলিনি।’ 

ডাকসুর জিএস এস এম ফরহাদ বলেন, ‘আমরা পুরো কাজের জন্য প্রেশার (চাপ) দিয়েছি। এসি যদি বিলাসবহুল হয়ে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় না দিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাটতি বাজেটের কারণে আমরা নিজস্ব উদ্যোগে সিসিটিভির ব্যবস্থা করেছি। প্রকৌশলীরা নতুন অনেক কিছু কিনতে চেয়েছেন; কিন্তু আমরা সতর্ক থেকেছি। পুরোনো অনেক জিনিস সংস্কার করে ব্যবহার করছি।’

Link copied!