এলসির দায় মেটানোর ডলার নেই দেশের ২০ ব্যাংকে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ৫, ২০২২, ০৮:১৮ পিএম

এলসির দায় মেটানোর ডলার নেই দেশের ২০ ব্যাংকে

দেশের অন্তত ২০টি ব্যাংকের কাছে এলসি দায় মেটানোর মতো কোনো ডলার নেই। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়েই ঘাটতিতে পড়েছে এসব ব্যাংক। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় থেকে সংগৃহীত ডলার দিয়েও নিজেদের আমদানি দায় ও গ্রাহকদের বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এ কারণে আমদানির নতুন এলসি খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলাও বন্ধ রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এই সব তথ্য উঠে এসেছে।

সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংকেই নেই ডলার

অগ্রণী ব্যাংকের অনুমোদিত ডলার সংরক্ষণের ক্ষমতা ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। আমদানি দায় পরিশোধের পরও এ পরিমাণ ডলার নিজেদের হিসাবে সংরক্ষণ করতে পারে ব্যাংকটি। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকটির কাছে বর্তমানে দায় মেটানোর মতো কোনো ডলারই নেই। উল্টো ২৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে ঘাটতি। আর সেটা মেটানো হয়েছে গ্রাহকদের হিসাবে থাকা ডলার ভাঙিয়ে। সংকটের কারণে যথাসময়ে ঋণপত্রের (এলসি) দায়ও পরিশোধ করতে পারছে না অগ্রণী ব্যাংক। এলসি দায় পরিশোধেও বিলম্ব ব্যাংকটির নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যে কয়েকটি ব্যাংকের কাছে এখনো ডলার আছে, সেগুলোও কমে আসছে। আর এ সংকটের কারণে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার। এক্সিম ব্যাংকের ধারণক্ষমতা ৫ কোটি ৩০ লাখ হলেও এ মুহূর্তে উদ্বৃত্ত কোনো ডলার নেই। উল্টো ৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঘাটতিতে পড়েছে। অগ্রণী কিংবা এক্সিম ব্যাংকের পরিস্থিতি এখন দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের।

এলসির দায় মেটাতে ব্যর্থ ব্যাংক

ডলার সংকটের কারণে দেশের অনেক ব্যাংকই নির্ধারিত তারিখে এলসি দায় পরিশোধ করতে পারছে না। কোনো কোনো দায় পরিশোধে এক মাসও বিলম্ব হচ্ছে। এ অবস্থায় এলসির নিশ্চয়তা দেয়া বিদেশী ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিদেশী অনেক ব্যাংকই এখন বাংলাদেশের জন্য নিজেদের ক্রেডিট লাইন কমিয়ে দিতে শুরু করেছে।

ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, বিদ্যমান ডলার সংকট পরিস্থিতি ভয়াবহ। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারছেন না। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যাংক এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ডলার ঘাটতির পরিমাণও বাড়ছে। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ যে হারে কমছে, তাতে ডলার সংকট আরো তীব্র হবে।

দেশের মোট রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রায় ৩০ শতাংশই আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। আবার রফতানি আয়ের দিক থেকেও ব্যাংকটির অবস্থান সবার শীর্ষে। তারপরও আমদানি দায় পরিশোধ নিয়ে বিপদে আছে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটি। ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এরই মধ্যে অনেক এলসি দায় পরিশোধে বিলম্ব করেছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ছাড়াও ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ কমার্স ব্যাংকের এলসি দায় পরিশোধে বিলম্ব করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংকসহ দেশের এক ডজন ব্যাংকের বিরুদ্ধে এলসি দায় বিলম্বে পরিশোধের অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, মাশরেক, এডিসিবি, অ্যাক্সিস ব্যাংকের বেশকিছু এলসি দায় নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে পারেনি ইসলামী ব্যাংক। কোনো কোনো এলসি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ৩০ দিন পর্যন্ত বিলম্ব হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্রে জানা গিয়েছে। যদিও ব্যাংকটির হিসাবে এখনো প্রায় ৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে।

অফশোর ব্যাংকিংয়ে স্থানান্তর হবে ডলার

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বলেন, ইসলামী ব্যাংক তাঁদের অনশোর ব্যাংকিং থেকে বেশকিছু ডলার অফশোর ব্যাংকিংয়ে স্থানান্তর করে বিনিয়োগ করেছে। এ কারণে নিট এক্সচেঞ্জ পজিশনে ৮৮ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত দেখালেও প্রকৃত অর্থে ব্যাংকটির হাতে ডলার নেই। এ কারণে ইসলামী ব্যাংক যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে।

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাও বলেন, দেশের কোনো ব্যাংকই চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না। এ কারণে সব ব্যাংকেই কমবেশি সংকট আছে। পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই আমরা কিছু এলসি দায় পরিশোধে বিলম্ব করেছি। তবে কিছুটা বিলম্ব হলেও সব এলসি দায় পরিশোধ করে দেয়া হচ্ছে। দেশের অকল্যাণ হয় এমন কোনো কাজ আমরা করি না। ডলারের জোগান বাড়ানোর জন্যও আমরা বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করছি, চলতি মাসের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

কোন ব্যাংক কত ঘাটতিতে

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলো নিজেদের রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ করতে পারে। কোনো ব্যাংক ডলার সংরক্ষণের অনুমোদিত সীমার সমপরিমাণ ঘাটতিতে থাকলে সেটিকে অবশ্য স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই দেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অনুমোদিত সীমার নিচে নেমে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানার বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ডলার ঘাটতিতে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ২৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড়িয়েছে। এছাড়া এক্সিম ব্যাংক ৮ কোটি ৮০ লাখ, ঢাকা ব্যাংক ৬ কোটি ৮০ লাখ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৬ কোটি ৪ লাখ, ইউসিবিএল ৪ কোটি ৯ লাখ, দ্য সিটি ব্যাংক ৪ কোটি ৭ লাখ, পূবালী ব্যাংক ৪ কোটি ৫ লাখ, প্রাইম ব্যাংক ৪ কোটি ২ লাখ ও সাউথইস্ট ব্যাংক ৪ কোটি ১ লাখ ডলার ঘাটতিতে রয়েছে। ইস্টার্ন ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ৩ কোটি ৫ লাখ ডলার। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৩ কোটি ৪ লাখ, ওয়ান ব্যাংক ৩২ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ২ কোটি ৭ লাখ, ন্যাশনাল ব্যাংক ২ কোটি ৪ লাখ, ব্যাংক এশিয়া ১ কোটি ৪ লাখ ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ১ কোটি ১ লাখ ডলার ঘাটতিতে রয়েছে। ৮০ লাখ ডলার করে ঘাটতিতে রয়েছে ট্রাস্ট, ব্র্যাক ও এনসিসি ব্যাংক। বিদেশী খাতের কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনেও ৪ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি রয়েছে।

ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, কোনো ব্যাংকের নিট এক্সচেঞ্জ পজিশনে ডলার ঘাটতির মানে হলো ওই ব্যাংকের হাতে কোনো উদ্বৃত্ত ডলার নেই। গ্রাহকদের আমানত হিসাবে থাকা ডলার ভেঙে অনেক সময় ঘাটতি মেটানো হয়। গ্রাহক আমানতের ডলার ফেরত চাইলে ব্যাংক দিতে পারবে না। কোনো ব্যাংকের ডলার ঘাটতি অনুমোদিত ডলারসীমার বেশি হয়ে গেলে বুঝতে হবে ওই ব্যাংক নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় থেকে ডলার সংগ্রহ করতে না পারলে আমদানি দায় পরিশোধে ওই ব্যাংক খেলাপি হতে বাধ্য।

রিজার্ভ থেকে ডলার পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো

নিজেদের সংকটের কথা জানাতে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে এবিবি ও বাফেদার দায়িত্বে থাকা ব্যাংক নির্বাহীরা ডলার সংকটের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার সহায়তা চান। এমডিরা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার সহায়তা দেওয়া না হলে দেশের অনেক ব্যাংকই এলসি দায় পরিশোধ করতে পারবে না। রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়া না হলে অন্তত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার সোয়াপ করার সুযোগ দিতে ব্যাংক এমডিরা অনুরোধ করেন। যদিও বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ব্যাংক এমডিদের দাবি সরাসরি নাকোচ করে দিয়েছেন।

সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে আমাদের এলসি খোলার পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি চৌকস টিম ব্যাংকের খোলা এলসিগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। গতকালও ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ৬৩ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, সহসা দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।

Link copied!