ডিসেম্বর-১৪: পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যা, বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

ডিসেম্বর ১৪, ২০২২, ০৮:৪০ এএম

ডিসেম্বর-১৪: পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যা, বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র

১৪ ডিসেম্বর। বাঙালি জাতির সবচেয়ে শোকাবহ দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে যখন মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় সুনিশ্চিত, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর এদেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ঔপন্যাসিক শহীদুল্লাহ কায়সার, নাট্যকার মুনির চৌধুরীসহ দেশের শ্রেষ্ঠ ও প্রতিভাবান বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে ঢাকার রায়েরবাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনায় আলবদর বাহিনীর আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন।

৮ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা শহরে ফের কারফিউ জারি হওয়ার সময় থেকে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ১০ ডিসেম্বর থেকে। আর পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি ১৪ ডিসেম্বর শেষ হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখক এবং অন্যান্য চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে অপহরণ করে হত্যা করে।

১৯৭২ সালের জাতীয়ভাবে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সংগ্রহ থেকে, বিভিন্ন প্রকাশনায় প্রকাশিত সংবাদ এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ সাময়িকী "নিউজ উইক"-এ আন্তর্জাতিক সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায় বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ছিলো ১ হাজারের বেশি।

ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিসহ অন্যান্য সূত্রমতে, একাত্তরে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন শিল্পী-সাহিত্যিক ও ৫ জন প্রকৌশলীসহ শহীদের সংখ্যা ১ হাজার ১১১ জন।

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে  বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের নির্মূল করার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। প্রথম দিকে তারা ২৫ মার্চের অন্ধকার রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অভিযানে সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করতে চেয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে হত্যা করা হয়। তবে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের বৃহত্তর অংশটি ঘটে ১৪ ডিসেম্বর, যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র ২ দিন আগে।

ঢাকার পতনের পর গভর্ণর হাউজ, যেটি এখন বঙ্গভবন নামে পরিচিত, সেখান থেকে রাও ফরমান আলীর একটি ডায়রি পাওয়া যায়। সেখানে অনেক নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা। তবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন রাও ফরমান আলী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে রাও ফরমান আলী বলেন, 'কাউকে হত্যা করতে হলে কি আমি এভাবে তালিকা সংরক্ষণ করব? অনেকে আমার কাছে এসে অনেকের নামে অভিযোগ করত। যেমন তিনি এটা করছেন, ওকে সাহায্য করছেন। আমি তাদের নাম টুকে রাখতাম, এর সঙ্গে ওই হত্যার কোনো সম্পর্ক নেই।' সাক্ষাতকারে গণহত্যা হয়নি বলেও জানান রাও ফরমান আলী।

১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে গিয়ে রাও ফরমান আলীর ওই সাক্ষাৎকারটি যৌথভাবে নিয়েছিলেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ।  

রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে হাইট এবং ডসস্পিক নামে দুই আমেরিকান নাগরিকের নামও পাওয়া গিয়েছিলো। তাদের নামের পাশাপাশি সিআইএ ও ডিজিআইএস লেখা ছিল। কারণ পুরো পরিকল্পনার পেছনে সিআইএ এবং ডিজিআইএস এর হস্তক্ষেপ ছিল বলে সন্দেহ করা হয়।

একাত্তরের এদিন মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদের জন্য এদিন নতুন প্রস্তাব তোলে। পরিষদের সভাপতি বলেন, বিকেলের আগে অধিবেশন শুরু হবে না। তারপরও ঢাকার পতন আসন্ন বুঝতে পেরে পরিষদের সদস্যরা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালাতে থাকে।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের সাতজন নেতা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, তারা সাহায্য করতে সামান্য বিলম্ব করলেও পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ডিসেম্বরের এদিন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু আজোরায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে বৈঠককালে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি ঠিক নয়। মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর দীর্ঘ আলোচনা করেন।

১৯৭১ সালের এদিন  মিত্র-মুক্তিবাহিনী বিজয়ীর বেশে চার দিক থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসে। যৌথ বাহিনী তথা ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ বিভিন্ন ভাষায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের বাণী লিফলেট করে আকাশে ছড়িয়ে দেন। ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতীয় মিগ-২১ জঙ্গি বিমান কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই ঢাকার নীলাকাশে উড়তে থাকে। প্রচারপত্রে পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, তারা আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার প্রতিরক্ষাবেষ্টনী যৌথ বাহিনীর চাপে ভাঙতে শুরু করলে পাকিস্তানি অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করেন। মালিক দৌড়ে এয়ার রেইড শেল্টারে আশ্রয় নিয়ে সেখানেই পদত্যাগপত্র লেখেন। এরপর তাঁর পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে রেডক্রস-ঘোষিত নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন।

১৯৭১ সালের এদিন বিভিন্ন জেলা শহর মুক্ত হওয়ার খবর আসে। আজকের এই দিনে পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এ্যাডওয়ার্ড পার্কে ওড়ে বিজয়ের পতাকা। মুক্ত হয় বগুড়া। এছাড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, বাড়েরহাটের মোড়েলগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা ও এলাকা শত্রুমুক্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন বই-পুস্তক ও গবেষণা থেকে সংগৃহীত ঘটনাবলী নিয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের দর্শক ও পাঠকদের জন্য প্রতিবেদন সিরিজ ‘বিজয়ের দিনলিপি’ তৈরি করা হয়েছে। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের ইউটিউব চ্যানেলেও প্রতিবেদনটি ভিজুয়ালি দেখা যাবে।

(মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন বই-পুস্তক ও গবেষণা থেকে সংগৃহীত ঘটনাবলী নিয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের দর্শক ও পাঠকদের জন্য প্রতিবেদন সিরিজ ‘বিজয়ের দিনলিপি’ তৈরি করা হয়েছে। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের ইউটিউব চ্যানেলেও প্রতিবেদনটি ভিজুয়ালি দেখা যাবে।)

Link copied!