ঢাকার শৃঙ্খলা ফেরাবে ‘মহানগর সরকার’, আটকে আছে ড্যাপের পরিকল্পনা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২, ০৫:২৪ এএম

ঢাকার শৃঙ্খলা ফেরাবে ‘মহানগর সরকার’, আটকে আছে ড্যাপের পরিকল্পনা

যত্রতত্র ভবন নির্মাণ, রাস্তা, ড্রেন, ফুটপাত দখল, মাত্রাতিরিক্ত গাড়ি, জনঘনত্ব, যানজট, শব্দ দূষণ, বাতাস-মাটি দূষণ, জলাবদ্ধতা ও খাল-নদীর পানি দূষণসহ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা। এসবের মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন। এর  থেকে ঢাকাকে রক্ষা করতে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের অংশ হিসেবে ‘মহানগর সরকার’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দাবি, এটি বাস্তবায়ন করা গেলে পুরো ঢাকাকে শৃঙ্খলার আওতায় আনা সম্ভব।

মহানগর সরকার কী?

মহানগর সরকার হচ্ছে স্থানীয় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। এই সরকারের বৈশিষ্ট্য হলো- নগর-পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় জনগণ এবং তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা মুখ্য হয়। মহানগর সরকারের কাঠামোতে সর্বোচ্চ ধাপে সব জনপ্রতিনিধির পক্ষ থেকে একজন প্রধান কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হবেন। পরবতী ধাপে পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়ন ও কার্য  সম্পাদন নামে দুটি সংস্থা কাজ করবে। বাংলাদেশের সংবিধানের পাঠ-৪ এর অধ্যায় ৩ এর ৫৯ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

রাজউক ও ডিএসসিসি কী চায়?

এই অপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন ঠেকাতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাউজক) পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ-উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। তবে সংস্থা দুটির বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপে নগরে শৃঙ্খলা ফিরবে না। নগরে শৃঙ্খলা ফেরাতে মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সংশোধিত নতুন ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ)।

কী ভাবছেন নগর পরিকল্পনাবিদগণ?

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, বিশ্বের জনঘনত্বের দিক থেকে ঢাকার বংশাল, গেন্ডারিয়া ও লালবাগে সর্বোচ্চ মানুষ বসবাস করেন। প্রতি একরে ৭শ’ থেকে ৮শ’ মানুষ বাস করেন। এসব এলাকায় বিশৃঙ্খলভাবে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে জনঘনত্ব বেড়েছে। দিনে দিনে বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা ও শনির আখড়াসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জনঘনত্ব বাড়ছে। ঢাকায় পরিকল্পনার অভাব আর বিশৃঙ্খলভাবে বহুতল গড়ে ওঠার পেছনে সরকারের সংস্থাগুলো সবার আগে দায়ী।

জানা গেছে, রাজধানীতে ভবন নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় ৫০টির মতো সরকারি সংস্থা রয়েছে। তবে এসব সংস্থাগুলোর কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। কাজেই ঢাকাকে বাঁচাতে চাইলে অর্ধশত সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আসতে হবে।  আর এটি কেবলমাত্র মহানগর সরকার গঠনের মাধ্যমেই সম্ভব বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদদের অনেকে।

ডিএনসিসি’র মেয়র যা বললেন

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, সরকারি-বেসরকারি যেকোনো সংস্থা এখন ডিএনসিসি এলাকায় উন্নয়ন কাজ করতে চাইলে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া যত্রতত্র উন্নয়ন কাজ আর নয়। সেজন্য এখন সরকারি সংস্থাগুলো উন্নয়ন কাজে সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি রাখছে।

চলতি বছরের ১৫ আগস্ট ঢাকার উত্তরায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) প্রকল্পে ক্রেন ছিঁড়ে একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু হয়। পরের দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ডিএনসিসির মেয়র কাজ বন্ধ করেন। ওই সময়ে তিনি বলেন, প্রকল্পের ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। কাজেই আপাতত বন্ধ থাকছে প্রকল্পের কাজ। নগরে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিআরটি, মেট্রোরেলসহ বেশকিছু প্রকল্পের কাজ চলমান। সবগুলো প্রকল্পের পরিচালকদের নগর ভবনে ডাকা হয়েছিল।

‘মহানগর সরকার ‘  নিয়ে রাজউক, আইপিডি, ডিএসসিসি যা বলে

রাজউক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর শৃঙ্খলা ফেরাতে নতুন ড্যাপে ‘মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠা’র কথা বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ঢাকায় শৃঙ্খলা ফিরবে। এতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যখন-তখন রাস্তা কাটা, যেখানে-সেখানে ভবন নির্মাণ ও প্রকল্প নিতে পারবে না। সুতরাং উন্নয়ন ও জনগণের চাপে নুয়ে পড়া ঢাকাকে বাঁচাতে চাইলে ‘মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠা’ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ঢাকার ভেতর ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়ার আগে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এই সমন্বয়হীতা দূর করতে মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি রাজউকের ড্যাপে উল্লেখ রয়েছে জানিয়ে রাজউকের এই প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, “ জার্মানি, কুরিয়া ও আমেরিকা নিজেদের শহরে শৃঙ্খলা ফেরাতে মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ঢাকা জনবহুল শহর এখানে যেকোনো সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে ভবন ও প্রকল্প নিচ্ছে। বিচ্ছিন্ন পরিকল্পনা দূর করতে মহানগর সরকার জরুরি।”

রাজধানী অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠায় বসবাসের নূন্যতম যোগ্যতা হারাচ্ছে এমন মন্তব্য করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘ঢাকায় মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠা হোক-সেটি সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। কারণ মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠা হলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমস্যা হবে। অনেকের প্রকল্প গ্রহণের নামে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে এতোদিনও ঢাকা মহানগর সরকার গঠিত হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ওইসময় যানজটে রাস্তার ওপর গাড়ি রেখে হেঁটে চলতে হবে মানুষকে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘উত্তর সিটির চেয়ে দক্ষিণ সিটিতে জনঘনত্ব বেশি। আর দক্ষিণ সিটির সবচেয়ে বেশি জনঘনত্ব হচ্ছে পুরান ঢাকা। এই এলাকার ঘিঞ্জি ভবন ভেঙে নতুন ভবন করে দেবে সরকার। কিন্তু এলাকার লোকজন রাজউক ও সিটি করপোরেশনের এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এসব এলাকাজুড়ে বিভিন্ন সংস্থা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এসব সংস্থার সাথে সিটি করপোরেশনের সমন্বয় নেই।’

তবে রাজউক ও ডিএসসিসি’র ‘মহানগর সরকার’ পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানার জন্য পরকিল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব (পরিকল্পনা বিভাগ) মো. মামুন-আল-রশীদকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে  যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি  ফোন রিসিভ করেননি। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

Link copied!