কথায় আছে- বাঙালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দেয় না। বয়স্করা বলে থাকেন, নিয়মিত দাঁত না মাজলে দাঁতে পোকা হয়। আগেকার যুগের মতো এখন আর কেউ কয়লা-ছাই দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করে না। এখন সবাই টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজে থাকেন। চিকিৎসকরা বলে থাকেন, প্রতিদিন অন্তত দুই বেলা দাঁত না মাজলে দাঁতের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যা আপনার বহু মূল্যবান সময় ও অর্থ- দুইয়েরই খরচের কারণ।
এছাড়া দাঁতে পোকা হয় বলে আমাদের দেশে একটা কুসংস্কার প্রচলিত আছে। বিষয়টা আক্ষরিক নয়। যদি কেউ আক্ষরিক অর্থে ধরে নেন তবে বিজ্ঞান চর্চায় তার কিছুটা ঘাটতি আছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। প্রকৃত অর্থে দাঁতে পোকা হয় না। নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার না করলে দাঁতের বিভিন্ন সমস্যাকেই এখানে ইঙ্গিত করা হয়ে থাকে।
অনেকের আবার দাঁত হলুদ বর্ণ ধারণের সমস্যাও আছে। এটা জন্মগতও হলে তো কথাই নেই। তবে যদি কোনো রোগ বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এমনটা হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে এখনই সাবধান হতে হবে। কেননা এর থেকেই আরও বড় বড় রোগের সূত্রপাত হতে পারে।
দন্ত্য বিশেষজ্ঞ ডা. হুদা মান্নান বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, “খাওয়ার পর সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ করা না হলে দাঁতে জমে থাকা খাবারে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে। এর ফলে মুখে অ্যাসিড উৎপন্ন হয়। ফলে দাঁতে ক্যাভিটি হয়। প্রকৃতপক্ষে সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ না করা ও দাঁতের অযত্নের কারণে হওয়া ক্যাভিটির ফলে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হয়ে যায়। এছাড়া দাঁতের মাড়ি সরে যাওয়া, পেরিওডন্টাইটিস, টার্টার, দাঁত ভেঙে যাওয়াসহ অন্যান্য ঘটনা যখন ঘটে, সাধারণ মানুষ তখন এটাকেই দাঁতে পোকা ধরেছে বলে মনে করে।”
চিকিৎসকের বক্তব্য অনুযায়ী যত্নের অভাবে দাঁতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তাই সুস্থ দাঁতের জন্য নিয়মিত পরিচর্যার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
তার মতে, নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার না করলে যেসব সমস্যা হয়:
১. দাঁতের ক্ষয় রোগ;
২. মাঢ়ির প্রদাহ;
৩. নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ;
৪. দাত শিরশির করা;
৫. ফাঁটা বা ভাঙা দাঁত;
৬. রুট ইনফেকশন;
৭. এনামেল ক্ষয়;
৮. শুকনো মুখ;
৯. ঘুমঘোরে দাঁতে শব্দ করা (ব্রুক্সিজম)।
গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্সার আক্রান্তদের ৩০ শতাংশই মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর মধ্যে আবার ৬১ শতাংশই হলো নারী। আরও ভয়াবহ তথ্য হলো তাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই পান, সুপারি ও বিভিন্ন তামাক জাতীয় দ্রব্য সেবনের ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সেই সঙ্গে দাঁতের বেশির ভাগ সমস্যার জন্য সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করেছেন গবেষকরা।
অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেছেন, দাঁতের বিভিন্ন সমস্যা থেকে শরীরে অন্যান্য রোগের সূত্রপাত হয়। আলঝেইমার, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, হজমের সমস্যার মতো বহু জটিল রোগ বা রোগের উপসর্গ শরীরে দানা বাঁধে।
দাঁতের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে বিবরণ তুলে ধরেছেন ইউনিভার্সিটি ডেন্টাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শিশু দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হুদা মান্নান। একই সঙ্গে দাঁতের যত্নেরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, “আমরা সব সময় বলে আসছি যে সঠিক নিয়ম মেনে দাঁতের যত্ন নিলে দাঁত সুন্দর ও মজবুত থাকবে দীর্ঘদিন। আমরা যদি সঠিক সময়ে দাঁতের যত্ন না নিই, তাহলে দাঁতে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দেবে। যেমন দাঁতে ক্যাভিটি, মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁত শিরশির সমস্যা প্রভৃতি। আর তাই দাঁত থাকতেই আমাদের দাঁতের যত্ন নিতে হবে। দাঁতের যত্নে নিয়মিত সকালে নাশতার পর ও রাতে খাবারের পর দুবার সঠিকভাবে দুই মিনিট ধরে একটি ভালো মানের টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। টুথব্রাশটিও কিন্তু ভালো মানেরও নরম হতে হবে। প্রতি ৩-৫ মাস পরপর ব্রাশ পরিবর্তন করতে হবে। শুধু দাঁত ব্রাশ করলেই হবে না, পাশাপাশি জিহ্বাও বেশ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। বিভিন্ন অ্যাসিডিক খাবার, ধূমপানসহ মদ্যপান, তামাক, জর্দা ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, যা দাঁতের স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর।”
দাঁতের মাঢ়ি থেকে রক্ত পড়ার কারণ
এর কারণ হিসেবে ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের অধ্যাপক ও বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারির উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, “দাঁতের সমস্যা মূলত দুটো কারণে হয়ে থাকে। প্রথম কারণ মাঢ়িতে ডেন্টাল প্লাক জমা থাকার কারণে মাড়িতে প্রদাহ সৃষ্টি এবং এর ফলে মাঢ়ি ফুলে যাওয়ার কারণে দাঁতের সঙ্গে সংযোগ নষ্ট হয়ে যায়।”
সাবধান করে দিয়ে তিনি আরও বলেন, “এমতাবস্থায় ব্রাশিং বা কোনো খাবার খেলে দাঁতের সঙ্গে রক্ত পড়ে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকোমিয়া, লিভারের সমস্যা, রক্তে প্লেটলেট বা হিমোগ্লোবিন কম থাকা যেমন প্লেট ডিজঅর্ডার বা রক্তের ব্যাধি। সেই সঙ্গে রক্ত পাতলা রাখা কিংবা হৃদরোগ ও অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও দাঁতের মাঢ়ি থেকে রক্ত পড়ে।”
মাঢ়ি থেকে রক্ত পড়ার উপসর্গ
দাঁতের মাঢ়ি থেকে রক্ত পড়ার চারটি উপসর্গের বিষয়ে ডা, অরূপ রতন চৌধুরী ধারণা দিয়েছেন। নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার না করলে এমনটা হতে পারে বলেও অভিমত দিয়েছেন তিনি।
১. মাঢ়ি লাল হওয়া ও ফুলে যাওয়া।
২. মাঢ়ি থেকে দাঁতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া।
৩. দাঁত ব্রাশ করলে বা শক্ত কোনো খাবার চিবিয়ে খেলে রক্ত বের হওয়া।
৪. অনেক ক্ষেত্রে ঘুম থেকে উঠলে মুখে রক্ত দেখা যাওয়া, আবার অনেক ক্ষেত্রে লালার সঙ্গে রক্ত মিশে গিয়ে বিছানায় বালিশেও রক্ত দেখা যাওয়া।
দাঁত চকচকে সাদা রাখার উপায়
দাঁত চকচকে সাদা রাখতে প্রতিদিন অন্তত দুই বেলা ব্রাশিং করতে হবে। নিয়মিত দাঁত মাজলে আপনাকে আর চিকিৎসকের থলেতে কাড়ি কাড়ি মুদ্রা ঢালতে হবে না। তবে টুথব্রাশেরও আছে রকমফের। চিকিৎসকরা মনে করেন, দাঁতের গড়ন ও আকৃতি ভেদে টুথ ব্রাশ ব্যবহার করা উচিত। যেমন নরম, মধ্যম ও শক্ত। তবে সেটা একজন দন্ত্য বিশেষজ্ঞের কাছে জেনে নেওয়া শ্রেয়। ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, “ফ্লুরইড যুক্ত টুথপেস্ট সবার জন্য গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ যে টুথপেস্টে ফ্লুরাইড আছে সেটাই স্বাস্থ্যসম্মত। কারণ ফ্লুরাইড দাঁতের ক্ষয় বা ডেন্টাল ক্যারিজ রোগ প্রতিরোধে সক্ষম।”