শ্রীলঙ্কা যে ভেতরে ভেতরে পুড়ছে সেটি প্রথমে খবরে আসে যখন জানা গেল আমদানি করা কাগজের অভাবে স্কুলে পরীক্ষা পর্যন্ত নিতে পারছে না দেশটির কর্তৃপক্ষ! এরপরের খবরটি আসে রান্নার গ্যাসের সংকটের পাশাপাশি কেরোসিন কিংবা পেট্রোলের জন্য মানুষের হাহাকারের। লোকজন লাইন ধরেও পাচ্ছিল না জ্বালানি তেল। চলমান বিদ্যুৎ সঙ্কট সেই পরিস্থিতিকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। বিদ্যুতের অভাবে শুরু হয় ঘন্টার পর ঘন্টা ব্ল্যাক আউট। পেট্রোল-গ্যাসের লাইনে লাগে দাঙ্গা। গুলিতে মারা যায় লোকজন। এসব খবর বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে মূহুর্তে। মানুষ জানতে পারে, আর্থিক দুরবস্থায় জনরোষে বিস্ফোরণের মুখে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ দেশটি।
জনবিক্ষোভে রাজধানী কলম্বো এ মূহুর্তে উত্তাল। জনতা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী এমনকি এমপিদের বাসাবাড়িতে হামলা চালাচ্ছে, আগুন দিচ্ছে। অনেককে গাড়িসুদ্ধ নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এসব ছবি ও ভিডিওতে সয়লাব এখন সোশ্যাল মিডিয়া। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে গদি ছেড়ে দিয়েছেন। জনরোষ তাতেও কমছে না।
পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় যে, মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ বেকারত্ব এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে শ্রীলঙ্কায়। অনেক শ্রীলংকান এরইমধ্যে বিদেশে উন্নত জীবনের আশায় নিজ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। অনেকে পালাবার উপায় খুঁজছেন। সবার অবশ্য দেশ ছাড়ার সামর্থ্য না থাকায় অগণিত শ্রীলংকান এখন মূল পেশার বাইরে অন্যকিছু করতে বাধ্য হচ্ছেন। নয়তো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিশ্ব মিডিয়ায় সেদেশের মানুষের দুর্ভোগচিত্র উঠে আসছে প্রতিদিন।১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো এতোটা দুরাবস্থায় পড়েনি দেশটি। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিবেশী ভারতের কাছে নতুন করে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চেয়েছে লংকান সরকার। শ্রীলংকা যখন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ২৫০ মিলিয়ন ডলারের কারেন্সি সহযোগিতা দিয়েছিল। এটি ছিল কোনো দেশের জন্য দেওয়া বাংলাদেশের প্রথম ঋণ। তারা আবারও ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশের কাছ থেকে। এছাড়া তারা পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ঋণ পরিশোধ করে আসছে।
অথচ কী না ছিল শ্রীলঙ্কার! লঙ্কার শ্রীতে মুগ্ধ হয়ে লাখো মানুষ দেশটিতে ভ্রমণে যেতো। দেশের উন্নয়নে পর্যটনের ছিল বিরাট ভূমিকা। একসময় সামাজিক সূচকেও শ্রীলঙ্কা ছিল এ অঞ্চলের সেরা। শিক্ষায় ছিল সবার তুলনায় এগিয়ে। পোশাক খাত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ঢুকেছিল শ্রীলঙ্কাতেই। কিন্তু গৃহযুদ্ধ আর চলমান কোভিড মহামারি তাদের জন্য সত্যিকারের কাল হয়ে দাঁড়ায়। শ্রীলঙ্কা আর সামনে এগোতে পারেনি।
এরইমধ্যে গত কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কা সরকার বিলাসী সব বড় প্রকল্প নিয়েছে, যার অনেকগুলোই আর্থিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভায়াবল ছিল না। নিজের সক্ষমতা না থাকায় ঋণ নিয়ে এ সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এখন এই ঋণই তার গলার ফাঁস হয়েছে। এ যেন ঋণ করে ঘি খাওয়া।
বিদেশি ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যয়ও এখন মেটাতে পারছে না শ্রীলঙ্কার সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেহিসাবি ব্যাংক নোট ছাপানো হয়েছে। এর ফলে দেশটির মূদ্রার মানে বড় ধরনের অবনমন হয়েছে। মূদ্রার ক্রয় ক্ষমতা তলানিতে নেমে আসায় বেড়েছে মূদ্রাস্ফীতি। এ মূহর্তে সরকারের আয় নেই। অতিমূল্যস্ফীতির দিকে গেছে দেশ। বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না পণ্য, পাওয়া গেলেও তার মূল্য দ্বিগুন-তিনগুন! বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহও বিঘ্নিত। আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। নাগরিকেরাও আছেন সীমাহীন কষ্টে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার আজকের এই অবস্থার জন্য দায়ী রাজাপক্ষ পরিবারের গোষ্ঠীতন্ত্র, খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্ত, ভুল নীতি, ভুল প্রকল্প বাছাই এবং পাহাড়সম দুর্নীতি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে যে আবারও ঋণ করবে শ্রীলঙ্কা, সে অবস্থাও নেই। ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দেশটির ওপর থেকে দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর আস্থা কমে গেছে। কেউ আর নতুন করে ঋণ দিতে চাচ্ছে না দেশটিকে। এখন সবার কাছে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, শ্রীলঙ্কা সরকার তাদের বিদেশি ঋণের দায় আর মেটাতে পারবে না।
শ্রীলঙ্কার আমদানি সক্ষমতা এখন শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। শ্রীলঙ্কা আগে থেকেই অনেকগুলো ভুল করছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দেশটি অনেকগুলো ভুল করেছে, কিন্তু ২০১৯ এ বড় বড় কয়েকটি ভুল করেছে। গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে ফেলেন, ন্যাশনাল রিবিল্ডিং ট্যাক্স তুলে দেন। কাজেই সরকারের রাজস্ব আয় প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যায়।
তারা ২০১৯ সালে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানি নিষিদ্ধ করে। ফলে তাদের কৃষিজাত ও খাদ্য উৎপাদনে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ফলন বিপর্যয় হয়। এর মধ্যে যখন করোনা মহামারি শুরু হয় তখন তাদের পর্যটন খাত থেকে আয় শূন্যের কোঠায় নেমে যায়, যেটা ছিল তাদের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত।
একই সঙ্গে বৈধ পথে তাদের রেমিট্যান্স আসাও প্রায় ৮৫ শতাংশ কমে যায়। অফিসিয়াল চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডিতে বেশি অর্থ পাওয়ায় দেশটির মানুষ বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দেন। বৈধ পথে এই রেমিট্যান্স না আসায় সেই অর্থ আমদানির কাজে ব্যবহার করতে পারেনি সরকার। আমাদের দেশেও হুন্ডির মাধ্যমে প্রায় ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার আসে। কিন্তু তারপরেও বৈধ চ্যানেলে ২০ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলার আসে। বাণিজ্য ঘাটতি পূরণের জন্য রেমিট্যান্স একটি বড় ভূমিকা রাখে। শ্রীলঙ্কায় বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স ৮৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় রিজার্ভ অতি দ্রুত শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে।
দেশটি খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। ফলন বিপর্যয়ের ফলে তাদের প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে খাদ্য আমদানি করতে। এতে তাদের রিজার্ভ অতি দ্রুত কমে ৫০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। রিজার্ভ না থাকায় খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ কিছুই তারা আমদানি করতে পারছে না।
শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলারের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু, এই টাকা তো আর সবার পকেটে যায় না। এখন প্রচণ্ড মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে দেশটিতে। ১ ডলারের বিপরীতে তারা পাচ্ছে ৩১৫ থেকে ৩৩০ রুপি। এই সব মিলিয়ে তাদের অর্থনীতি একেবারে ধসে গেছে।
শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ পরিস্থিতি এক নয় যদিও। তবে এখানেও অনেক বড় প্রকল্পের লাভজনকতা নিয়ে আছে প্রশ্ন। বাড়ছে মূল্যস্ফীতির চাপ। প্রবাসী আয়ও কমছে। একদিকে আমদানি ব্যয় যেমন নতুন রেকর্ড ছাড়াচ্ছে, চলতি হিসাবের ঘাটতিতেও তৈরি হচ্ছে নতুন রেকর্ড। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা আরও বলছেন, এ মূহুর্তে ভাল আছি মানেই যে সব সময় ভাল থাকা যাবে, মোটেও তা নয়। শ্রীলঙ্কার সঙ্কট একদিনে তৈরি হয়নি। বাংলাদেশও এরকম বেশ কিছু প্রকল্প আছে। এর সবগুলোর প্রয়োজন রয়েছে, এমনটা মনে করেন না অর্থনীতিবিদেরা।
এরমধ্যে লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে চলমান রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা হচ্ছে। দেশে এমনিতেই বিদ্যুত উদ্বৃত্ত রয়েছে। উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহারও হচ্ছে না। অথচ রাশিয়া থেকে অনমনীয় ঋণ নিয়ে বিশাল ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়ছে।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের চাইতে বেশি ব্যয়ে সংযোগ রেল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। যমুনা নদীতে নতুন করে রেল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প লাভজনক না হলে পস্তাতে হবে বাংলাদেশকে।
গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে সরকারের কর্মীদের বেতন ভাতা ও পেনশন বাবদ ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের চাপ বাড়ছে। বিভিন্ন খাতে সাবসিডিও বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। এই ধারা চলতে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। এর থেকে উত্তরণে সরকারের কর আহরণেও গুরুত্ব দিতে হবে।
শ্রীলঙ্কায় চলমান অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে প্রথমেই যে শিক্ষাটি নিতে হবে তা হলো, কোনো সংকটই একদিনে সৃষ্টি হয় না। যেকোনো সংকট আসার অনেক আগেই তার লক্ষণ ফুটে উঠে। লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হলে যে কোন ধরনের বিপর্যয় সামাল দেওয়া সম্ভব। প্রয়োজন এবং সামর্থ্যের বেশি সরকারি ব্যয় শ্রীলঙ্কার দীর্ঘদিন ধরে চলমান একটা সমস্যা। বাড়তি ব্যয়ের ফলে সৃষ্ট ঋণের চাপ সামাল দিতে গিয়ে দেশটি দেউলিয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও তেমন পর্যায়ে যায়নি। কিন্তু শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি দেখে সতর্ক পদক্ষেপে না চললে হোচট খেতে পারে বাংলাদেশ।
লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট