যুক্তরাষ্ট্র যে তালিবানদেরকে জঙ্গি আখ্যায়িত করতো, হ্যাঁ, সেই তালিবানদের কথাই বলছি। তাঁরাই আফগানিস্তানের ক্ষমতা নিয়েছে আজ বছর বাদে চার দিন। বিশ্ব মিডিয়ায় এককালের জঙ্গি-বর্তমানে যোদ্ধাজ্ঞান করা এই তালিবান জঙ্গিরা আফগানিস্তানের স্থানীয় সরকার আর যুক্তরাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে গতো ২০ বছর একটানা লড়াই করে গেছে। এবং বর্তমানে তাঁরাই এখন সরকার।
বিশ্বের কোনো দেশের স্বীকৃতি না থাকলেও বাস্তবতা এটাই। আফগানিস্তান এখন তালিবানদের হাতেই।
২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা কোনো লোক যদি হঠাৎ মুক্তি পায়, বাইরের আলো দেখলে তাঁর যে অনুভূতি হয়, টানা ২০ বছর ধরে থাকা একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহাওয়ার হঠাৎ অবসান হলেও একটা অযাচিত ধাক্কা তো আসেই।
আফগানিস্তানেরই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতিটা ভালো নেই আর আসলে। আমাদের ভয়াবহ সময় পার করতে হচ্ছে। এ সংকট থেকে বের হতে সময় লাগলেও বের হওয়া সম্ভব।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবরোধ, ব্যাংকিং খাতের সংকট, এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে এখন প্রশ্নটা, তালিবানরা কি পারবে এ সংকট কাটিয়ে উঠতে?
প্রাক্তন সরকারের ডেপুটি মিনিস্টার সুলাইমান বিন শাহর দাবি, তাঁরা অদক্ষ। এ সংকট মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট দক্ষতা তাদের নেই। এবং সংকট উত্তরণে কি কি দক্ষতার প্রয়োজন, সেটাও জানা নেই তাদের।
কিন্তু এসবের সাথে সাধারণের জান-মাল- নিত্যপ্রয়োজনের সম্পর্ক কি? আর দেশটাই বা কোন দিকে যাচ্ছে?
সেসব জানতেই আমাদের এই সিরিজ আয়োজন “তালিবানের একাল সেকাল- পারবে কি তালিবান বর্তমান আফগানিস্তানের অর্থ সংকট কাটিয়ে উঠতে?
বাস্তবতা খুব কঠোরভাবেই আঘাত করেছে আফগানিস্তানকে। সামান্য এক রুটি নিয়েও কাড়াকাড়ির দেখা মেলে ওখানে এখন। বাস্তবতা এটাই যে, আফগানিস্তানের মানুষ ক্ষুধার্ত থাকেন। সেসব দেখা আর দেখানোও সম্ভব হয়না পুলিশি কড়াকড়িতে।
কাবুলেই জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামাধীন এন জি ও সংস্থায়, মানুষকে মাসের পর মাস ধরে খাবার আর ত্রাণের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
তাদের দাবি অনুযায়ী, আফগানিস্তানে এখন ২২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের পর্যাপ্ত খাবার নেই, হিসেবে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি।
ফুড প্রোগ্রামে খাদ্য সাহায্য নিতে আসা সবজি বিক্রেতা আব্দুল খালিক জানালেন, “৩০০-৪০০ আফগানি আয় ছিল আমার। কিন্তু গতো এক বছরে কোনো আয়-রোজগারই নেই আমার, পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা মুশকিল এখন”।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের মুখপাত্র ফিলিপে জানান, “ স্যালারি বলতে কোনো কথা নেই এখন আর, জীবন মান তো নেই-ই । অর্থনৈতিক সংকটের এক বছর হতে চললো, মানিয়ে নেবার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই অসহায় এই আফগানিদের।“
তবে খানিক অপেক্ষা করুন, আজকের আফগানিদের এতো সব মুশকিলের পেছনের আসল রহস্যটা কী?
সেসব ই জানবো, দ্বিতীয় পর্বে!
এখানেই বিদায় নিচ্ছিনা, সে রহস্যের জট আমরা খুলতে শুরু করবো ধীরে ধীরে ঠিকই কিন্তু আপাতত আফগানিস্তানের বর্তমান হালচাল আর উত্তরণের সম্ভাবনার দিকেই একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখি। তালিবানদের দেয়া প্রথম বার্ষিক বাজেটেই ৫০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘাটতি আছে।
তবে কি “টেবিলে সবার পাতে খাবার, সবার জন্য সুচিকিৎসা, শিক্ষা, এসবের জন্য এই বাজেট মোটেও পর্যাপ্ত নয়” – প্রাক্তন ডেপুটি মিনিস্টার সুলাইমানের করা এমন দাবিই সত্য। পাঠক, আপাতদৃষ্টিতে এই দাবিই সত্য। কিন্তু তালিবান এই ঘাটতি পূরণের টাকা পাবে কোথায়?
তালিবানরা ইতোমধ্যেই অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়া সব রকম সরকারি দপ্তরই বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি হিউম্যান রাইটস কমিশনকেও তাঁরা অতোটা প্রয়োজনীয় মনে করছে না। নিজেদের সকল সরকারী কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সুযোগ সুবিধা কমিয়ে দিয়েছে সাধারণ জনগনের স্বার্থে।
ওদিকে তাঁদেরকে আবার একই সাথে আই এস আই এল এর অঙ্গ সংগঠন আই এস কে পি এর সাথেও নিয়মিত লড়াই করে যেতে হচ্ছে। মরার উপর খারার ঘা হয়ে এসে গেলো প্রাণঘাতী ভয়াবহ এক ভূমিকম্প। সাথে নিয়ে গেলো হাজারের ও বেশি প্রাণ।
এতো সব হতাশা-বেদনা-চ্যালেঞ্জের মধ্যে খানিক স্বস্তির খবর এটাই যে, মিলিয়ন মিলিয়ন সহায়তা এসে পৌছাচ্ছে দেশটিতে নিয়মিতভাবেই। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য , গতো ২০ বছরের শোষক যুক্তরাষ্ট্রই পাঠিয়েছে ৭২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সহায়তা আসলে আফগানিস্তানের জনসাধারণের উন্নয়নের জন্য কি পর্যাপ্ত? মোটেও না! তবে জনগণকে বাঁচিয়ে রাখতে আপাতত এটুক সাহায্যকেই পর্যাপ্ত ধরে এগোতে হচ্ছে তাদেরকে। এতে করে জীবন মানের উন্নয়ন কি হবে? স্বস্তি এটাই, জীবন মান বাড়ুক না বাড়ুক, জীবনটা বাঁচুক অন্তত আপাতত!
আন্তর্জাতিকভাবেই বিশ্বের সবার সঙ্গে এক হয়ে কাজ করে যাবার চিন্তার মতো ভালো বিকল্প তাঁদের জন্য আর হতেই পারেনা এই মুহূর্তে।
সবকিছু মিলিয়ে, এ এক নতুন সূর্যোদয় আফগানিস্তানে। এ এক নিদারুণ উচ্ছলতার সকাল আফগানিস্তানের। যে সকালে কোনো মোহ নেই, নির্মমতা নেই, ভয়াল করাল গ্রাসের ভয় নেই। আকাশ থেকে বোমা পরে মরে যাবার ভয় নেই। সকালটা আগের বহু সকালের থেকে খানিক বেশিই নিরাপদ। আতঙ্ক নেই। অর্থ যৎসামান্য যাদের আছে, তাঁরাই নির্বিঘ্নে দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারছেন। এ সকাল যুদ্ধহীন জীবনের, এ সকাল সুন্দর! তবুও বাঁচার আকুতি যেন মায়ায় জড়িয়েই যায়… খাবারের আহুতি যেন দুমড়ে মুচড়ে চায় বিশ্বমানবতার হৃদয়… উত্তরণ পেতেই হবে আফগানিস্তানকে।
আল-জাজিরা অবলম্বনে নিয়াজ মাহমুদ সাকিব