আত্মঘাতী বাঙালি। বাঙালি বহুবার আত্মঘাতী হয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে যখন ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অবলম্বনের ঘোষণা এলো, তখন অনেক সমালোচনা উঠেছিল। এই সমালোচনা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মধ্যে যেমন উঠেছিল, তেমনই মুসলিমদের মধ্যেও উঠেছিল। মুসলিম তো অভিমানবশত গোটা শতাব্দিই ইংরেজি থেকে দূরে অবস্থান করে বসল।
শ্রীযুক্ত নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ গ্রন্থে বাঙালির তথাকথিত ইংরেজির প্রতি বিরাগের জোর সমালোচনা করেছেন। সেই গ্রন্থের ৩৪ নং পৃষ্ঠায় তার দৃষ্টান্তও উল্লেখ করেছেন: ইংরেজী ভাষার ও ইংরেজীতে শিক্ষার প্রবর্তন সম্বন্ধেও কয়েকটা কথা বলা দরকার। এ-বিষয়ে শুধু বাঙালি নয়, সমস্ত ভারতবাসীর মুখেই একটা অযৌক্তিক কথা শোনা যায়। সেটা এই যে, ইংরেজ শাসক আমাদিগকে গোলাম বানাইবার জন্য ইংরেজিতে শিক্ষার প্রবর্তন করিয়াছিল। অর্থাৎ ইংরেজদের শাসন চালাইবার জন্য কেরানী ও হাকিম জাতীয় ভারতবাসীর প্রয়োজন ছিল, তাই আমাদের ইংরেজী শিখিতে বাধ্য করিয়াছিল। এই কথাটা আমি বাল্যকাল থেকেই শুনিয়া আসিতেছি। আমি তখন ক্লাস সিক্সে (পুরাতন পঞ্চম শ্রেণিতে) পড়ি। কেদার বলিয়া একটি বালক আমার সঙ্গে পড়িত। সে ইংরেজীতে অত্যন্ত কাঁচা ছিল। দিনের পর দিন ক্লাসে অপদস্থ হইয়া একদিন সে আত্মগ্লানি হইতে মুক্ত হইবার জন্য এক কাণ্ড করিল। ইংরেজী পাঠ্যপুস্তকটি ছিঁড়িয়া পদদলিত করিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল- ‘গোলাম হইবার ভাষা আমি বর্জন করিলাম’ (তৃতীয় অধ্যায়: ইংরেজী ভাষার প্রচার ও প্রসার)।
ইংরেজি ভাষা কি শুধু আমাদের ভারতবাসীকে গোলাম বানানোর জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রবর্তন করা হয়েছে? প্রকৃত ইতিহাস দেখতে গেলে আমরা দেখতে পাই, গোলাম বানানোর কোনও অভিপ্রায় ব্রিটিশদের মধ্যে ছিল। বরং ভারতবাসীর শেখার আগ্রহ থেকেই ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে খোদ ব্রিটেনবাসীই ভারতে ইংরেজি প্রবর্তন হওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ বক্তা মেকলে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, ভারতে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করা হলে আশু ভারতবাসীর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি উন্নতমানের হবে। রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও ভারতবাসীর এই চাহিদার কথা ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে তুলে ধরেছিলেন। সেসবের ইতিহাসই তুলে ধরেছেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী।
১৮৯৭ সালের ২৩ নভেম্বর জন্ম নেওয়া এই লেখকের জন্মস্থান অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) কিশোরগঞ্জের একটি মহকুমা শহরে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মঘেঁষা শিক্ষিত উদারমনোভাবাপন্ন পারিবারিক পরিবেশে। উদারনৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠায় পরবর্তীতে মুক্ত ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী এবং অকপট সত্যভাষণের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। এভাবেই তিনি তার গ্রন্থের ১৫৮ নং পৃষ্ঠায় তার মায়ের সঙ্গে কথোপকথন উল্লেখ করেছেন। সেই কথোপকথনের উদ্ধৃতি দেবো। কিন্তু প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষাপট জানার সুবিধার জন্য তার আগের ও পরের উদ্ধৃতিগুলোও উল্লেখ করা আশু প্রয়োজন বলে মনে করছি। গ্রন্থকারের বয়ান ছিল এরূপ: আমার মনে পড়ে ছাত্রাবস্থায় ‘মর্যাল-কনশাসনেস’ কথাটা শিখিবার পর, মাতার সঙ্গে কথা বলিতে গিয়া কি বিভ্রাট হইয়াছিল। বিবাহের পর মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয় এ-বিষয়ে চিন্তা করিতে করিতে একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মা, বিয়ের পর তোমার কোন নৈতিক পরিবর্তন হয়েছিল কি?’ মা ব্রাহ্মপন্থী, ‘নীতি’, ‘নৈতিক’ বলিতে ব্রাহ্মরা যাহা বুঝিত তাহাই বুঝিতেন। তিনি বলিলেন, ‘সে-আবার কি? নৈতিক পরিবর্তন কি বুঝিতে পারছি না?’ হয়ত ‘নৈতিক’ কথাটা শুনিয়া তিনি কুলটা-বা-বারাঙ্গনা-বৃত্তি সম্বন্ধে ইঙ্গিতে করিতেছি ভাবিলেন (অষ্টম অধ্যায়: চরিত্রবল ও ঈশ্বরপ্রেম)।
‘আত্মঘাতী বাঙালী’ গ্রন্থটি প্রাবন্ধিক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর দ্বিতীয় বাংলা গ্রন্থ। প্রথমটির নাম ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ (১৯৬৮)। এর আগে ১৯৫১ সালে দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননন ইন্ডিয়ান নামে ইংরেজি ভাষায় তার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ হয়। নীরদচন্দ্র চৌধুরী ১৯৭০ সাল থেকৈ আমৃত্যু ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে বসবাস করেন। এক সংবর্ধনায় তার সম্পর্কে একজন ভারতীয় বক্তা বলেছিলেন, তার মতো ইংরেজির দক্ষতা অনেক ভারতীয়ের নেই। সেই সভায় একজন ইংরেজ রাজপুরুষ উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, বক্তার কথায় ভুল আছে। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতো ইংরেজিতে পারদর্শিতা ভারতীয় তো দূরের কথা, ইংরেজদের মধ্যে দুর্লভ।
‘আত্মঘাতী বাঙালী’ গ্রন্থটি প্রকৃত অর্থে সমালোচনাধর্মী একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্যপ্রেমী পাঠকদের জন্য সুনিবেদিত গ্রন্থ এটি। বিশেষ করে সাহিত্য সমালোচকদের কাছে অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত এটি। ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ ১৯৮৮ সালের ২৩ নভেম্বর (অগ্রহায়ণ, ১৩৯৫) প্রথম প্রকাশ হয়। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছেন সুব্রত চৌধুরী। মুদ্রণ করেছেন চয়নিকা প্রেস। গ্রন্থটির ভারতীয় মূল্য: ৬৫ রুপি।