যাঁরা বাংলাদেশে সৎ-সাংবাদিকতা করেন তাঁদের জন্য ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ একটি আলোচিত ও স্মরণার্হ-স্মর্তব্য একটি দিন। এদিন রাজধানীর একটি হোটেলে একেবারে কপর্দকহীন অবস্থায় আত্মহনন করেন দেশে নতুন ধারার সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃত মিনার মাহমুদ।
সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশের পর থেকেই এই 'মিনার' নামটি বহুবার শুনেছি আমি। অগ্রজ-সিনিয়রদের ভাষ্য, মিনার সত্যিকার অর্থেই নীতি-নৈতিকতা ও মেধার বিচারে 'মিনারের' মতোই 'সুউচ্চ' এক সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিকতায় যেমন মেধা দরকার, তেমনি সততাও দরকার। যে কোনো একটির ঘাটতি হলে পরে সাংবাদিকতা হয় না। এ দুটোই মিনার মাহমুদের ছিল। মিনার মাহমুদ সম্পর্কে এসব প্রশংসাগাঁথা শুনে তাঁর প্রতি একধরনের মুগ্ধতা জন্মে আমার।
বাংলাদেশে সাপ্তাহিক পত্রিকায় রিপোর্টিং ভিত্তিক বিদ্রোহীধারায় আধুনিকতার প্রবর্তক ছিলেন মিনার মাহমুদ। পড়েছেন দেশের উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। ছাত্র জীবনে তিনি লেখালিখি শুরু করেন। যে ফরিদপুরে তাঁর জন্ম, সেখানে থাকার সময় এক সময়ের আলোড়ন তোলা সংগঠন ‘লেখক শিবির’ করতেন তিনি। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ঝড়তোলা সব প্রতিবেদন করে রিপোর্টিংয়ের সনাতনী প্রথাটাই ভেঙে দেন মিনার। রিপোর্টিংয়ে সোজা কথা সাদাভাবে বলতে পারতেন মিনার।
১৯৮৭ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সেই ধূমকেতুর মতো সম্পাদক হিসেবে মিনার মাহমুদের আবির্ভাব। ৩২ পৃষ্ঠার নিউজপ্রিন্টের বিচিন্তা তাঁকে কিংবদন্তীতুল্য সাফল্য এনে দেয়।
বিচিন্তায় সে সময় ছিল তারুণ্যের সম্মিলন। পত্রিকাটিতে যাঁরা কাজ করতেন তাঁদের তখন গড় বয়স ছিল ২৪! সোজাসাপ্টা প্রতিবেদন করতে গিয়ে সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রোষানলেও পড়েন মিনার মাহমুদ। যেতে হয় জেলখানায়। বন্ধ করে দেওয়া হয় পত্রিকাটির প্রকাশনা।
১৯৯০ সালে সামরিক শাসন হটিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয় দেশে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে মিনার মাহমুদ দ্বিতীয় দফায় বিচিন্তা প্রকাশ করেন। তবে যাত্রাটা মসৃণ হয়নি তাঁর জন্য। নানা মহলের মামলা, হয়রানির কারণে কিছু দিন পর পত্রিকাটি বন্ধ করে দিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে বাধ্য হন।
দীর্ঘ নির্বাসন শেষ করে ২০০৯ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি শুরু করতে চান সাংবাদিকতাই। আবারও বিচিন্তা প্রকাশ করতে শুরু করেন তিনি। ‘করপোরেট সংস্কৃতি’র দাপট সামাল দিতে না পেরে এ দফায়ও হাল ছাড়েন মিনার মাহমুদ। চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘ স্বেচ্ছাপরবাস থেকে দেশে এসেছিলেন মিনার মাহমুদ। অনেক স্বপ্ন নিয়ে। সৎ সাংবাদিকতার স্বপ্ন। শোনা যায়, যাঁদের তিনি একদিন ক্যারিয়ার গড়ে দিয়েছিলেন, তাঁরাই কেউ তাঁকে সহযোগিতা করেনি। এসব নিয়ে মিনারের মনে পাহাড়সমান অভিমান ছিল হয়ত। ঢাকায় তাঁর পরিচিত সহকর্মীদের কাছেও গিয়েছিলেন নতুন স্বপ্নের কথা বলতে। তাঁরা নতুন স্বপ্নের কী শুনবেন? তাঁরা এক কাপ রঙ চা খাইয়ে বিদায় করেছেন তাঁকে। কেউ সেই সৌজন্যতাও দেখায়নি পাছে চাকরি দিতে হয় তাঁকে! চাকরি দিলে নিজের চাকরি খোয়ানোর ঝুঁকি হতে পারে, ভেবেছিলেন তারা। তাঁরা ভাববেনই বা না কেন; মিনার তো তাঁদের চেয়েও মেধাবী ও সৎ সাংবাদিক। মিনার তাঁদের সাথে থাকলে তাঁদের চাকরিঝুঁকি তো হবেই।
এ অবস্থায় ২০১২ সালের ২৯ মার্চ খবর পেলাম, মিনার মাহমুদ নিজেই সংবাদ হয়েছেন। এই পৃথিবীর পঙ্কিলতা থেকে তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। দেশের সাংবাদিকতা নামের কূটিলতা থেকে তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে ’পবিত্র’ থাকবার অপরাজেয় রেকর্ড অক্ষুন্ন রাখলেন। তিনি অভিযোগ করতে ভালবাসতেন না। যে কারণে তাঁর পাঁচ পৃষ্ঠার সুইসাইড নোটে ঢাকার সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর অভিমানের ছিটেফোঁটাও মিলল না।
যেভাবে কায়দা করে অপলেখ এড়িয়ে সংবাদ লিখতে হয়, ঠিক সেভাবেই কায়দা ক'রে সুইসাইড নোটের এক জায়গায় লিখে দিলেন, 'আমার মৃত্যুর জন্য কেউই দায়ী নয়।'
আহা মিনার মাহমদু! পেশদারিত্ব দেখালেন এখানেও! বিনয় প্রকাশের জন্য তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে-ছাপিয়ে গেলেন। সত্যিই কি তাঁর মৃত্যুর জন্য কেউই দায়ী নয়?
মিনার মাহমুদ যেদিন মারা গেলেন, সেদিন এক আড্ডায় ছিলাম আমি। সেখানেই খবর আসে তাঁর মৃত্যুর। তখন আড্ডায় উপস্থিত এক সম্পাদক হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘শোনেন হিমেল, আমেরিকা থেকে ফেরার পর উনি আমার কাছেও এসেছিলেন। চাকরির জন্য। আমি ভেবেছি, তিনি মশকরা করছেন হয়ত। তার মৃত্যু সত্যিই দুঃখজনক।’
তাঁর সেদিনের সেই কাষ্ঠহাসি এবং সেই হাসির সাথে মেশানো কপট দুঃখপ্রকাশ আমাকেও নিদারুন ব্যথিত করেছিল। এরাই এখন মিডিয়ার সর্বাগ্রে। এদের কারণেই মিনারদের মতো সৎ-মেধাবী সাংবাদিকরা কোনঠাঁসা হন যুগে যুগে, কেউ কেউ বেছে নেন আত্মহননের পথ। যাঁরা সেটিও পারেন না, তাঁদের মৃত্যু হয় বিনা চিকিৎসায়, হৃদরোগসহ নানা দুশ্চিন্তারোগে।
মিনার মাহমুদ আজ নেই। তিনি এখন চিরঘুমে বিশ্রাম নিচ্ছেন মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। তাঁর ‘বিচিন্তা’, গল্পের বই ‘মনে পড়ে রুবী রায়’ উপন্যাস ‘আমার দেবী ফুলন’ জার্নাল- ‘পিছনে ফেলে আসি’, ‘নির্ঘুম স্বপ্নের দেশে’ এখনো যে ঘুরছে বিদগ্ধ পাঠকের হাতে হাতে! তাহলে কীভাবে নেই তিনি! বরং তিনিই আছেন তাঁর সকল না-থাকা জুড়ে। আর যারা তাঁকে তাঁর পেশা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, ঠকিয়েছে, বঞ্চিত করেছে; বরং তাঁরাই পদে পদে মরছে প্রতিদিন।
লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট