এপ্রিল ১৮, ২০২১, ০৪:০৪ পিএম
হেমেন্দ্রকুমার রায় বাংলা ও বাঙালি সাহিত্যের ইতিহাসে একজন সাহিত্যিক ও গীতিকার হিসেবে সমধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তবে সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। শিল্পের সবকটি শাখাতেই তার ছিল অবাধ যাতায়াত। জীবনকালে যেমন সম্মান ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন। তেমনি মৃত্যুর পরেও বাঙালি সাহিত্য পাঠক তাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে।
হেমেন্দুকুমার মূলত শিশুকাল থেকেই সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হয়ে উঠেন। সেসময় তিনি ভালো ছবিও আঁকতে পারতেন। শিল্পের প্রতি অতি আগ্রহের জায়গা থেকে একসময়ে হয়ে উঠেন নৃত্য পরিচালক। তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সীতা নাটকের নৃত্য পরিচালক ছিলেন। বাংলায় শিল্প সমালোচনা ক্ষেত্রেও তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ছোটদের জন্য রহস্য রোমাঞ্চ ও গোয়েন্দা গল্প লিখে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে বেশ প্রসিদ্ধ অর্জন করেন।
হেমেন্দ্রকুমার রায় ১৮৮৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। পরে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬৩ সালের ১৮ এপ্রিল। ছোটবেলা থেকে পারিবারিক নাম ছিল প্রসাদদাস রায়। তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০৩ সালে বসুধা পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘আমার কাহিনী’ প্রকাশিত হয়।
১৯১৫ সালে নতুন রূপে প্রকাশিত ‘ভারতী’ পত্রিকার লেখকগোষ্ঠীতে হেমেন্দ্রকুমার যোগ দেন। পরবর্তীতে সেখানে তার নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। এছাড়া ১৯২৩ সালে ‘মৌচাক’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন এবং এ পত্রিকায় তার বিভিন্ন ধরনের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে।
১৯২৪ সালে তিনি ‘সাপ্তাহিক নাচঘর’ ও ‘ছন্দা’ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। এছাড়া মাসিকপত্র ‘রংমশাল’সহ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদনার সাথেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
১৯২৩ সালের পর হেমেন্দ্রকুমার ‘মৌচাক’ পত্রিকার সম্পাদক সুধীরচন্দ্র সরকারের সম্মতি নিয়েই ছোটদের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী লিখতে শুরু করেন। এই পত্রিকায় তার প্রথম অ্যাডভেঞ্চার গল্প ‘যকের ধন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে।
এই গল্পের সাফল্যের পর থেকেই ‘মৌচাক’ পত্রিকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠলো অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্য গল্প। অ্যাডভেঞ্চার ও গোয়েন্দা গল্পের কারণে ‘মৌচাক’ পত্রিকার জনপ্রিয়তা দেখে সমকালীন অন্যান্য নামীদামী লেখকেরা এ ধরনের গল্প লিখতে উৎসাহিত হয়েছিলেন।
অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী ছাড়াও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার পদচারণা ছিল উল্লেখ করার মতো। ইতিহাসভিত্তিক রচনা লেখায় তিনি বেশ বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন, লিখেছেন নানা বই। ‘আলো দিয়ে গেল যারা’, ‘ভগবানের চাবুক’ ইত্যাদি তার ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ। তার লেখার বিষয়বস্তু ছিলো অবাক হওয়ার মতোই। ‘আলোকচিত্রের নবধারা’, ‘রোদ্যার শিল্পচাতুর্য’, ‘মিশরের আর্ট’, ‘মানুষখেকো গাছ’ নামের বিচিত্র ধরনের বই ও লিখে গেছেন তিনি।
ছোটদের জন্য তিনি ৮০টিরও বেশি বই লিখেছিলেন। এর মধ্যে কবিতা, নাটক, হাসি ও ভূতের গল্প, অ্যাডভেঞ্চার, ও গোয়েন্দা কাহিনী, ঐতিহাসিক উপন্যাস সব কিছুই ছিল। তাঁর সৃষ্ট বিমল-কুমার, জয়ন্ত-মানিক, পুলিশ ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু বাংলা কিশোর সাহিত্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য চরিত্র।
হেমেন্দ্রকুমার রায় বড়দের জন্যও বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: জলের আলপনা, বেনোজল, পদ্মকাঁটা, ঝড়ের যাত্রী, যাঁদের দেখেছি, বাংলা রঙ্গালয় ও শিশিরকুমার, ওমর খৈয়ামের রুবায়ত প্রভৃতি। তার সিঁদুর চুপড়ি গল্পটি জার্মান ভাষায় অনুদিত হয়ে একটি সঙ্কলন গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।
হেমেন্দ্রকুমার ছিলেন একজন সার্থক গীতিকার এবং সুরকার, এককথায় বলা চলে বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন একজন মানুষ। শচীন দেববর্মণ, কৃষ্ণচন্দ্র দে'র মতো প্রখ্যাত শিল্পীরাও গেয়েছেন তার গান। সে সময়ের বাংলা মঞ্চ এবং গ্রামাফোনে গাওয়া গানের প্রচলিত ধারা এবং রুচির আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তার রচিত অনেক গান তৎকালীন সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘অন্ধকারের অন্তরেতে’ গানটি এর মধ্যে অন্যতম।