স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ

প্রিয়নীল রহমান

এপ্রিল ৩, ২০২১, ০৮:০৮ পিএম

স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুবিখ্যাত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকে বেড়ে ওঠেন এক নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশে, যা তাকে শুধু ঈর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারীই করেনি, প্রেরণা জুগিয়েছে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান দি অনারেবল সোসাইটি অফ লিংকন ইন থেকে ১৯৩৮ সালে ব্যারিস্টার-এট-ল অর্জনে। তিনি ছিলেন প্রগাঢ় মানবতাবোধসম্পন্ন আলোকিত একজন মানুষ। তার মা আফজালুন নেছা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ভগ্নি। বাবা সৈয়দ আবদুস সালিক এক সময় বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

পেশাগত জীবনে তার কঠোর পরিশ্রম ও অসামান্য মেধা তাকে নিয়ে গেছে খ্যাতির শীর্ষে। ১৯৫৪ সালের শেষদিকে তিনি হাইকোর্টে যোগ দেন এবং একই বছর বিচারক পদে নিযুক্ত হন। বিচারপতি মোর্শেদ পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত।

১৯৬৪ সালে তিনি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি এ দেশের আইন আদালতের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালে তার কিছু ঐতিহাসিক রায় এবং সাংবিধানিক ব্যাখ্যা উপমহাদেশের পরিধি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

আইন পেশার পাশাপাশি আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন ও শোষণের বিপরীতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এবং ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বলা হয়ে থাকে, ২১ দফা দাবির প্রথম খসড়াটি তিনিই প্রণয়ন করেছিলেন।

বিচারপতি মোর্শেদ তার জীবদ্দশায় শুধু বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না, তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। পেশাগত সুখ্যাতি, মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও সাধারণের মাঝে তার অংশগ্রহণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা ও অবস্থানের গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। সে সময় ঐতিহাসিক ‘নেহেরু-লিয়াকত’ চুক্তি প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

আইয়ুব খানের ঐতিহাসিক গোলটেবিল বৈঠকে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৬৯) সমগ্র পাকিস্তানের যে ৩৫ নেতা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন তাদের অন্যতম। সেই বৈঠকে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমাদের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইতিহাসবিদদের মতে, সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সামরিক জান্তাদের রক্তচক্ষুর সামনে এ দাবি ছিনিয়ে আনেন। এর আগে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সমানসংখ্যাক আসন নির্ধারিত ছিল।

বিচারপতি মোর্শেদের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতি গ্রহণের ফলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) আসন সংখ্যা ১৫০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৯।

রাজনৈতিকভাবে এ আসন সংখ্যার বিভাজনটি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে পরাভূত করে, যার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৭০-এর নির্বাচনে। বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের এ অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পাকিস্তানের সামরিকজান্তা আইয়ুব খান তার সামরিক শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে যখন ‘আগড়তলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করেন, সে সময় বিচারপতি মোর্শেদ প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জনতার কাতারে এসে দাঁড়ান।

সে সময় অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব আসামির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে এবং তাদের মুক্তির জন্য সভা-সমাবেশ-সেমিনারে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে আবেদন জানান। তার এ অবদানের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে কখনও মোছা যাবে না। 

চল্লিশের দশকের প্রথমার্থে লেখক হিসেবে বিচারপতি মোর্শেদের পরিচিতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকায় বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর ফিলিস্তিন এবং আরব বিশ্বে তিনি বিশেষভাবে প্রশংসিত হন। ‘স্টেটসম্যান’  পত্রিকায় ‘কায়েদে আজম’ সম্পর্কে সমালোচনার সে সময়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।  ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে বিচারক হিসেবে শপথ নেন। এ ক্ষেত্রে তার বুদ্ধিমত্তা এবং প্রজ্ঞার পরিচয় সর্বজনবিদিত।

১৯৫৪ সালের ২১ দফা কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, যা ২১ দফারই সারাংশ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উনসত্তরে ছাত্রদের উত্থাপিত ১১ দফা দাবির প্রতিপাদ্য বিষয় যে একই সূত্রে গাঁথা, ইতিহাস বিশ্লেষকদের তা-ও দৃষ্টি এড়ায়নি। এসব দাবি প্রণয়নে তার মেধা এবং মননশীলতার কারণেই তিনি বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন পাকিস্তানী সরকারের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেন। মূলত তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী একজন নির্ভীক সৈনিক। ১৯৬৮ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যদের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক তথাকথিত মামলা দায়ের করা হয়। বিচারপতি মোরশেদ এর প্রতিবাদস্বরূপ প্রধান বিচারপতির পদ ত্যাগ করেন।

বিচারপতি মোরশেদ তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য এবং প্রজ্ঞা-মেধার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারকে মূল্য দিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি একদিকে আইয়ুব খানের তথা সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি এ দেশবাসীর অকুণ্ঠ সম্মান-শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা লাভ করেছিলেন তিনি। বিশেষত যারা স্বাধীনতাকামী অর্থাৎ বাংলাদেশ নামের একটি স্বপ্ন বুকে ধারণ করেছিলেন, মূলত তাঁদের জন্য সময়টি ছিল ক্রান্তিকাল। ঠিক সেই সময় নির্ভীকতা, ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিচারপতি মোরশেদ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন।

বিচারপতি মোর্শেদের মতো প্রজ্ঞাবান আরো অনেক বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ব্যক্তিত্বের অবদান রয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামের এই দেশটিকে গড়ার পেছনে। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক তাঁদের পাশে অকুতোভয় লাখো সৈনিক মা-বোনদের ইজ্জত, একসাগর শহীদের রক্তে স্নাত আমাদের স্বাধীনতা এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতকে শক্তিশালী করেছিলেন।

গণতন্ত্রই মানুষের সর্বোচ্চ অধিকার— এই কথা মনে রেখেই তিনি সর্বদা তার ঐতিহাসিক বিচার বিভাগীয় রায় দিয়েছেন।

মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার সুচিন্তিত ‘ওয়ান ম্যান’-‘ওয়ান ভোট’ পদ্ধতি আজ সর্বজনস্বীকৃত, এটি সত্তরের  নির্বাচনের সময় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।

বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ এটি শুধু একটি নাম নয়, ইতিহাসের কিংবদন্তি অবিস্মরণীয় নাম। নতুন প্রজন্মকে তার সম্পর্কে জানাতে হবে। কারণ তাকে জানলে ইতিহাস জানা যাবে, বাংলাদেশকে জানা যাবে। তিনি আমাদের বাতিঘর অনুপ্রেরণার উৎস।

এই মহান মানুষ ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তিনি বেঁচে আছেন কোটি হৃদয়ের শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়।

Link copied!