নভেম্বর ২২, ২০২৩, ০১:৫০ পিএম
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনলাইন ভিত্তিক মনোনয়ন কার্যক্রমের দিকে জোর দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনি পরিবেশ বজায় রাখতে শোডাউন ও হুমকি বিতর্ক এড়াতে অনলাইনে মনোনয়ন জমার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনলাইনে মনোনয়ন ফরম ক্রয় ও জমাদানের জন্য ‘স্মার্ট নমিনেশন’ নামে একটি অ্যাপ চালু করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে অনলাইনের চেয়ে কার্যালয়ে শোডাউনের দিকেই নজর ছিল বেশি।
দলীয় নির্দেশনার বিপরীত বাস্তব চিত্র
গত শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) মনোনয়ন বিক্রির আগের দিন দলের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিকে জানানো হয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কোনো প্রকার অতিরিক্ত লোকসমাগম ছাড়া প্রার্থী নিজে অথবা প্রার্থীর একজন যোগ্য প্রতিনিধির মাধ্যমে আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমা প্রদান করতে হবে। কিন্তু সরেজমিনের চিত্র ছিলো একেবারের ভিন্ন।
টানা চারদিনের (১৮ নভেম্বর থেকে ২১ নভেম্বর) পর্যন্ত সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই কার্যক্রমে সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকেই রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে এর আশপাশের এলাকায় ব্যাহত হয় স্বাভাবিক যানচলাচল, অন্যদিকে রমনা ভবন, পীর ইয়ামীনী সহ আশেপাশের মার্কেট গুলোতেও পরে এর প্রভাব।
দলীয় নির্দেশনা অমান্য করেই মনোনয়ন প্রত্যাশীরা শত শত সমর্থক ব্যানার, ফেস্টুন, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মনোনয়ন সংগ্রহ ও জমা দেয়ার জন্য আসে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেকটাই হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
সরাসরি বনাম অনলাইনে যত মনোনয়ন
প্রথম দিন: ১ হাজার ৫০ জন সরাসরি মনোনয়ন সংগ্রহ করেন। এর বিপরীতে ১৪ জন মনোনয়ন সংগ্রহ করেন অনলাইনে। সরাসরি মনোনয়ন বিক্রি করে আয় হয় ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা ও অনলাইনে মনোনয়ন থেকে আয় হয় ৭ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় দিন: মোট ১ হাজার ২১২টি ফরমের মধ্যে সরাসরি ক্রয় করা হয় ১ হাজার ১৮০টি এবং অনলাইনে ৩২টি। ফরম বিক্রি করে দলের আয় ৬ কোটি ৬ লাখ টাকা।
তৃতীয় দিন: এই দিন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন ৭৩৩ জন। এর মধ্যে সরাসরি ৭০৯ জন আর অনলাইনে ২৪ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। মনোনয়ন ফরম বিক্রি ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার।
চতুর্থ দিন: ৩৪৫টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি থেকে আয় হয় ১ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয় হয়েছে। এর মধ্যে সরাসরি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয় ৩০২টি এবং অনলাইনে ৫১টি।
পরিসংখ্যান বলছে, সর্বোমোট ৩৩৬২ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করলেও অনলাইনে সংগ্রহ করেছেন মাত্র ১২১ জন।
অনলাইন মনোনয়ন সংগ্রহে কেন অনীহা?
মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পর জাতীয় নির্বাচন আসে। নিঃসন্দেহে এটি আনন্দের। আর সেই আনন্দ ভাগা ভাগি করে নিতে সকলকে সঙ্গে নিয়ে ঢাক-ঢোল ব্যান্ড পার্টি নিয়ে মনোনয়ন কিনতে আসেন বলে জানিয়েছেন অনেকে।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, মনোনয়ন প্রত্যাশিত আসনে তাদের জনপ্রিয়তা কতটুকু তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই এই আয়োজন করে মনোনয়ন কেনা ও জমা দেয়া।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন দলীয় শক্তির মহড়া কিংবা স্থানীয় ভাবে নিজের জনপ্রিয়তা জাহির করতে লোকবল প্রদশর্ন করতে পুরনো পন্থায় মনোনয়ন কিনতে আগ্রহী প্রত্যশীরা। তবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি বড় স্বার্থকতা তৈরি হতো যদি নেতাকর্মীরা সরাসরি কেনার বদলে অনলাইনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতেন।
ঢাকা-১৭ আসনে অনলাইনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনে জমা দেন বর্তমান সংসদ ও দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত। অনলাইনে মনোনয়নপত্র ক্রয় এবং জমাদান প্রসঙ্গে মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র স্বপ্ন দেখায় না। সেটির বাস্তবায়নও করে। আওয়ামী লীগ ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের যে রূপরেখা দিয়েছে, সেটি বাস্তবায়নের প্রথম ধাপে নিজেদের দলীয় মনোনয়নপত্র ক্রয় এবং বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো অনলাইন সেবা চালু করেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘২০৪১ সালে বাংলাদেশকে হবে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে আমরা চলে যাব। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার চারটি ভিত্তি রয়েছে। এক. আমাদের প্রত্যেক সিটিজেন প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হবেন। আর তারা হবেন স্মার্ট সিটিজেন। দুই. স্মার্ট ইকোনমি অর্থাৎ সমস্ত ইকোনমিক কার্যক্রমে আমরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে করব। তিন. স্মার্ট গভর্মেন্ট, ইতিমধ্যে আমরা অনেকটা করে ফেলেছি, সেটাও পুরোপুরি করে ফেলব এবং চার. আমাদের সমস্ত সমাজটাই হবে স্মার্ট সোসাইটি।‘
উৎসব মনে করে ভীড়
তার এমন বক্তব্য কিংবা উদ্যগে তেমন কোন সাড়া পড়েনি দলের অন্য নেতাদের মাঝে। ব্যাপক কর্মী সমর্থকদের নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মনোনয়ন ফরম জমা দিতে আসা অভিনেত্রী মাহীয়া মাহী’র কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি আচরণ বিধি লঙ্ঘন করেছেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয় এটি একটি উৎসব, এখানে অনেক লোকজন আসবে এটি স্বাভাবিক। প্রতিটা প্রার্থীর সঙ্গে পাঁচশো থেকে এক হাজার লোক আসছে এবং তারা ঢাকঢোল পিটিয়ে আসছে। আমি কিন্তু ঢাকঢোল পিটিয়ে আসিনি। শুধু স্লোগান দিতে দিতে এসেছি। আমার সঙ্গে আমার এলাকার মানুষ আসবে, এই শুভদিনে পাশে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এটাকে আমি আচরণ বিধি লঙ্ঘন বলে মনে করছি না। আমি সব রকমের আচরণবিধি মানছি এবং মানবো।
মনোনয়ন ফরম জমা দিতে এসে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছেন ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম। বিশাল শোডাউন নিয়ে ছাদ খোলা ব্যক্তিগত গাড়িতে দাঁড়িয়ে নেতাকর্মী ও জনসাধারণের মাঝে বিলিয়েছেন কমলা।
এ সময় ২৫টি ঘোড়ার গাড়ি, অর্ধশত মোটরসাইকেল ও ১৫টি প্রাইভেট কার, পিকআপ ভ্যান সহ গাড়ি বহর নিয়ে সাউন্ড সিস্টেমে গান বাজিয়ে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এসেছেন হাজী সেলিম।
এ সময় হাজী সেলিমের ছেলে সোলায়মান সেলিম বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, তরুণ প্রজন্মের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের গতি আরও বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে কাজ করব। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারব।‘
‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অগ্রণী ভূমিকা পালন করার’ প্রত্যয় ব্যাক্ত করা হাজী সেলিমের পুত্র নিজেই হননি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার সারথী। অনলাইনে মনোনয়ন সংগ্রহ না করে এসেছেন বড় ধরণের শোডাউন করে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাদের সঙ্গে আসা কর্মীদের ভিড়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের আশেপাশে রাস্তায় যানচলাচল ছিলো প্রায় বন্ধ। এতো জনস্রোতে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতেই হিমসিম খেতে হয়েছে। সারাদেশের মনোনয়ন প্রত্যাশী ও সমর্থকদের জনস্রোত ছিলো কেন্দ্রীয় কার্যালয়মুখী। মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম বিক্রির শেষদিন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান দলের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া।
এদিন টানা চারদিনে মনোনয়ন কার্যক্রমে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও এর আশেপাশে ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের ভোগান্তি হওয়ায় সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তিনি।
মনোনয়ন বিক্রি কম, আয় বেশি
আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে ৩ হাজার ৩৬২টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে আওয়ামী লীগ, যা ২০১৮ সালের চেয়ে কম। এবার ফরম বিক্রি করে তাদের আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা ২০১৮ সালের চেয়ে বেশি। বর্তমানে প্রতি মনোনয়ন ফরমের দাম নির্ধারন করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা।
তবে এর আগে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে ৪ হাজার ২৩টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে আওয়ামী লীগ। তখন প্রতি মনোনয়ন পত্রের দাম নির্ধারিত ছিল ৩০ হাজার টাকা। সে সময় আয় হয় ১২ কোটি ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
গত নির্বাচনের হিসাবে এবার ৬৬১টি ফরম কম বিক্রি হয়েছে। তবে আয় বেড়েছে ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
যেভাবে অনলাইনে মনোনয়ন
অ্যাপের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়েবসাইট থেকেও অনলাইনে মনোনয়ন ফরম পূরণ করে জমা দেয়ার সুযোগ ছিলো।
অনলাইনে ফরম পূরণ ও জমা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই গুগল প্লে স্টোর অথবা ওআইওএস অ্যাপ স্টোর থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড করে ইনস্টল করে অথবা ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে রেজিস্ট্রেশন করে এরপর লগইন করে নিয়ম অনুযায়ী ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ৫০ হাজার টাকা পেমেন্ট সম্পন্ন করার পর মনোনয়ন ফরম পূরণ ও জমাদান কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কিন্তু অনলাইনে অনীহা দেখিয়ে শোডাউনে জোর দিতে দেখা গেছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের।
এই ওয়েবসাইট ও অ্যাপের মাধ্যমে মনোনয়ন ফরম থেকে বাছাইকৃত প্রার্থীদের তালিকা প্রদান করা হবে। এ ছাড়াও দলীয় কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে বলে জানানো হয় আওয়ামী লীগের দপ্তর থেকে।