ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫, ১২:৩৭ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ ও গুরুতর আহতসহ অনেক বিক্ষোভকারীর সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান দল। গতকাল বুধবার এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধে জাতিসংঘ পাঁচটি খাতে জরুরি ভিত্তিতে ও ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ করেছে। যেসব খাতে সংস্কারের সুপারিশ করেছে, সেগুলো হল- জবাবদিহিতা ও বিচারব্যবস্থা; পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী; নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ; রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক সুশাসন ও দুর্নীতি দমন।
সংস্থাটি বলছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে সবার আগে এসব খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হওয়া যাবে।
এক নজরে দেখে নেয়া যাক, পাঁচটি খাতে জরুরি ভিত্তিতে ও ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশসমূহ-
জবাবদিহিতা ও বিচারব্যবস্থা
বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করে তোলা।
বিচার বহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, গুম এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ সংরক্ষণ ও ধ্বংস বা লুকানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
সামরিক ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের ক্ষেত্রে নিয়মিত আদালতে বিচার নিশ্চিত করা।
নিরপেক্ষ ও স্বাধীন প্রসিকিউশন সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করা।
বিচারকদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ করা।
মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োগের উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া এবং তা সম্পূর্ণ বাতিলের দিকে অগ্রসর হওয়া।
পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী
জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের জন্য মারণাস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে ধাতব (প্রাণঘাতী) গুলি দেওয়া বন্ধ করা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জড়িত ব্যক্তিদের এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে মারণাস্ত্রের ব্যবহার না করে শৃঙ্খলা ফেরানোর কৌশল শেখানো হবে।
নির্বিচারে গণগ্রেপ্তার ও ভুয়া মামলার প্রবণতা বন্ধ করা।
পুলিশ বিভাগের নিয়োগ ও পদোন্নতি স্বচ্ছ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত করা।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বিলুপ্ত করা। বিজিবিকে সীমান্তসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অন্য কিছুতে যুক্ত না করা এবং ডিজিএফআইয়ের কাজ সামরিক গোয়েন্দা তৎপরতায় সীমাবদ্ধ রাখা।
স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করে পুলিশি অপরাধ তদন্ত ও অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা।
নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনের জন্য ব্যবহৃত কঠোর ও বিতর্কিত ফৌজদারি আইনগুলোর প্রয়োগ স্থগিত করা ও পরবর্তীতে সংশোধন করা।
সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শ্রমিকনেতা, নাগরিক অধিকারকর্মীসহ বিরোধী দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা।
অনৈতিক নজরদারি বন্ধ করা এবং নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাগিরির বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত করা।
ইন্টারনেট বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং স্বাধীন ও মুক্ত ইন্টারনেট নিশ্চিত করা।
মানবাধিকার কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর করে তোলা।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা।
রাজনৈতিক দলসমূহের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় মানবাধিকার নীতিমালা মেনে চলার ব্যবস্থা করা।
বহুদলীয় গণতন্ত্র বজায় রাখা এবং কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করা।
নারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা।
অর্থনৈতিক সুশাসন ও দুর্নীতি দমন
দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং বৈদেশিক লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
দুর্নীতিবিরোধী কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর করা।
বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর একাধিপত্য রোধ করা।
ন্যায্য কর ব্যবস্থা চালু করা এবং ধনী ও বৃহৎ ব্যবসায়ীদের উপর সরাসরি কর বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় বৈষম্য কমানো।
শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের অধিকার, ন্যূনতম মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।
এছাড়া জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশে তদন্তের জন্য আমন্ত্রণ জানানো ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি উত্থাপন করার সুপারিশও করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।