বাংলাদেশের অসম্ভাব্য বিপ্লবীরা: একজন ৮৪ বছর বয়সী এবং কিছু ছাত্র…

ফাইনান্সিয়াল টাইমস

নভেম্বর ৩, ২০২৪, ০৬:৫৮ পিএম

বাংলাদেশের অসম্ভাব্য বিপ্লবীরা: একজন ৮৪ বছর বয়সী এবং কিছু ছাত্র…

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকায় সড়কে এখনও নানা গ্রাফিতি চোখে পড়ছে: একটি মুষ্টিবদ্ধ হাত, এক আহত ছাত্রকে সাইকেলে করে সাহায্যের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; ‘শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না’ লেখা।

এই চিত্রকর্মগুলো জুলাই ও আগস্ট মাসে আঁকা হয়েছিল, যখন পুলিশ কোটা সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনে সমবেত হওয়া মানুষের উপর গুলি চালায়। শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গণঅভ্যুত্থানের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। যা সাম্প্রতিককালে জনগণের ক্ষমতার একটি অন্যতম জয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ছাত্ররা এটাকে বিপ্লব বলে অভিহিত করছে, যে বিপ্লব তিন মাস হয়েছে। আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পরই ছাত্ররা ৮৪ বছর বয়সী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তা মুহাম্মদ ইউনূসকে “প্রধান উপদেষ্টা”হিসেবে আমন্ত্রণ জানান।

কার্যত তিনি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতা হিসেবে কাজ করছেন। ড. ইউনূস বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক সংস্কার শুরু করেছেন। ভবিষ্যতে একটি নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

চলমান সংস্কার কার্যক্রমে ছাত্ররা একটি বিশেষ অবস্থানে রয়েছে, যেখানে দুইজন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদে আছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বর্তমান দায়িত্বের পর তিনি রাজনীতিতে থাকবেন না।

সম্প্রতি জাতিসংঘ সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তাদের সামনে ঢাকায় সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান নিয়ে প্রকাশিত একটি বই উপস্থাপন করেন। 

আরও পড়ুনঃসত্যি কি প্রবাসী সরকার গঠন করবে আওয়ামী লীগ?
প্রধান উপদেষ্টা ফাইনান্সিয়াল টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে ছাত্রদের সম্পর্কে বলেন, ‘তারা দেশের নায়ক। তারাই বিজয়ী। বিপ্লব তারা নিয়ে এসেছে।’
তরুণরা সরকারের শক্তি এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী যে পরিবর্তনগুলি প্রস্তাব করছেন, তা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আগে কখনও দেখা যায়নি — ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতের পতনের পর কেন্দ্রীয় ইউরোপে শুরু হওয়া সংস্কারের মতো, অথবা ২০১১ সালের পরে মিয়ানমারের সামরিক শাসনের অবসানের মতো।


প্রধান উপদেষ্টা ফাইনান্সিয়াল টাইমসে দেয়া সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগকে "ফ্যাসিবাদী" বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ তারা পুলিশ এবং আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। যা নির্মূল করতে তিনি সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন, যাদের কাজ হলো রাষ্ট্রের ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো পুনর্গঠন করা। এর মধ্যে রয়েছে, দেশের সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, যেসব মানুষকে আয়নাঘরে নির্যাতন বা হত্যা করা হয়েছে, তাদের সঠিক হিসাব দিতে হবে। কমিশনগুলিকে নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে রিপোর্ট জমা করতে হবে।

এদিকে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যাংক মালিকদের দ্বারা বিদেশে পাচার করা প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার অনুসন্ধান এবং পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন। যা শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিশাল দুর্নীতির অভিযোগের একটি অংশ।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, যদিও বাংলাদেশ একটি প্রতিশ্রুতি সমৃদ্ধ মুহূর্তে রয়েছে, কিন্তু বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এই দেশটিতে, যেখানে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর রাজনৈতিক যাত্রা প্রায়শই অস্বস্তিকর ছিল, সেখানে বর্তমান রাষ্ট্র নায়ক এবং তার ছোট্ট দলটির জন্য বর্তমান পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং একটি জুয়াও বটে। তিনি এবং তার সহকর্মীরা যা করছেন তার জন্য বিপ্লবই সঠিক শব্দ। তিনি নির্বাচনের জন্য চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন না। তিনি ইতিমধ্যে বহুপাক্ষিক ঋণদাতা এবং পশ্চিমা সরকারগুলোর সমর্থন পেয়েছেন।

এখনো আন্দোলনকারীরা ঢাকার রাস্তায় প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে, সম্প্রতি তারা বিগত শাসক দ্বারা নিয়োজিত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে।  

শেখ হাসিনার পতনের পর কিছু সংখ্যালঘু হিন্দুদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। এ ঘটনাটি ভারতের শাসক গোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করেছিল। কেননা তারা ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এসেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি অংশীদার ভারতের বর্তমান শাসক শ্রেণির একটি বৃহৎ অংশের সাথে বৈরী অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ভারত জোর দিয়ে বলছে যে এটি মার্কিন সমর্থিত শাসন পরিবর্তন। পুরোনো শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামপন্থীরা আবার সক্রিয় হতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে কিছু শারিয়া আইন প্রয়োগের পক্ষে, এমনকি একটি বাংলাদেশি খিলাফত সৃষ্টির ধারণাও সমর্থন করে।

হিন্দুদের হত্যার আখ্যান ভারত আলোচনার বিষয় হয়েছে এবং নরেন্দ্র মোদির সরকারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা, যারা এখন আত্মগোপনে বা নির্বাসনে রয়েছেন, তারা দাবি করেছেন, তাদের অনেক সমর্থককে টার্গেট করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও এমপি খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ফোনে ফাইনান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, “৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার সদস্যকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে।”

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইউনূসের রিসেট বাটন মন্তব্যেরও সমালোচনা করেছেন। বলেন, "রিসেট বোতাম টিপুন মানে আপনাকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং অতীতকে মুছে ফেলতে হবে। কিন্তু জনগণ তাদের সেটা করার অনুমতি দেবে না।"

আরও পড়ুনঃ প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এর দালিলিক কোনো প্রমাণ নেই

সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়েছে। এই গণ অভ্যুত্থানের কারণে কিছু ব্যবসায়ী এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাকশিল্প থেকে তাদের অর্ডার অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের তালিকা থেকে বের করতে সাহায্য করেছে এবং বর্তমানে লক্ষ লক্ষ নারীকে কর্মসংস্থান দিয়েছে।

ড.ইউনুস বলেন, “শিক্ষার্থীদের সরকার দখল করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, বরং তারা কেবল কিছু সাধারণ ও যৌক্তিক দাবি করছিল, যা একসময় বিপ্লবে রূপ নেয়”।


আসিফ মাহমুদ ২৬ বছর বয়সী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের ছাত্র ছিলেন, যিনি এখন যুব, ক্রীড়া এবং শ্রম উপদেষ্টা ।

 

আসিফ মাহমুদ বলেন, “বিপ্লব এখনও শেষ হয়নি। সংস্কার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই ম্যান্ডেটটি পূরণ করতে হবে।”

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরবর্তীতে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতারা অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক ও মাইক্রোফাইন্যান্সের পথিকৃৎ ইউনুসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে জনগণের পছন্দ হিসাবে সামনে নিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর, তিনি প্যারিস থেকে চিকিৎসা শেষে ঢাকায় ফেরেন।


ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “গত ১৫ বছরে, বিগত সরকার সম্পূর্ণ রাজনীতিকে একটি চরম অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলো যার ফলে তারা মনে করেছিল তারা চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে।  

বাংলাদেশের পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই এবং আগস্টে ৮০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন — যদিও বিশ্লেষকরা মনে করেন যে প্রকৃত সংখ্যা ২,০০০ পর্যন্ত হতে পারে, যা দেশের সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতার সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি আওয়ামী লীগ সমর্থকদের তুলনায় গুরুতর নয়। যদি আপনি বাংলাদেশের বিপ্লব পরবর্তী সময়কে আরব বসন্তের মতো অন্যান্য বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করেন, তবে আমাদের পরিস্থিতি অনেক ভালো।

 

আসিফ নজরুল বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার  আমাদের দেশের প্রায় সব সম্পদ লুট করেছে। এখন তারা আন্তর্জাতিক লবিং এবং শক্তিশালী স্বার্থের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে এবং এই সরকারকে কলঙ্কিত করতে চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার দাবি করে বলেছিলেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে প্রতিটি বাড়ি পুড়ে যাবে।”


শেখ হাসিনার বাবা, শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন। রাজধানীর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে তার বাড়ি যা পরবর্তীতে শেখ হাসিনা জাদুঘরে রূপান্তরিত করেছিল। বিক্ষোভকারীরা সেই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তিও ভেঙে ফেলে। এমনকি শেখ হাসিনার শেষ শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত “বঙ্গবন্ধু কর্নার”ধ্বংস করা হয়।

 

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, শেখ হাসিনার শাসনকালে যে সকল বিএনপি নেতারা আক্রান্ত হয়েছিলও। তারাই আওয়ামী লীগকে অপরাধমূলক মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করছে। এটি চাঁদাবাজির একটি ভালো উপায়।

 

আন্দোলনকারীরা কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে, যা সমালোচকদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হয়েছে। অক্টোবরের শুরুতে, প্রায় ৩০০ জনের একটি গ্রুপ সুপ্রিম কোর্টে জমায়েত হয়ে তাদের দৃষ্টিতে রাজনৈতিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকদের একটি তালিকা উপস্থাপন করে; এর মধ্যে প্রায় দশজন কে পরে ছুটিতে পাঠানো হয়। এটি আগস্টের ঘটনার প্রতিধ্বনি করে, যখন ছাত্র নেতৃত্বাধীন একটি জনতা একটি আদালতে প্রবেশ করে এবং তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে।


সম্প্রতি কিছু বিএনপি সদস্য দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি জানাচ্ছেন; দলের অনেক সদস্য মনে করেন যে তারা সহজেই জয়লাভ করবে। যদি ল আওয়ামী লীগকে আবারও নির্বাচনে দাঁড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৌলিক সংস্কার কার্যকর করার জন্য যৌক্তিক সময় দিয়েছি।”


এদিকে, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একটি যোগাযোগ তালিকা ব্যবহার করে, প্রধান উপদেষ্টা বহু-পক্ষীয় ঋণদাতা এবং পশ্চিমা সরকারের সমর্থন পেয়েছেন।


বাংলাদেশের নির্বাচনের তারিখ নিয়ে চাপের মধ্যে পড়বেন কি না? প্রধান উপদেষ্টাকে এমন প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন “চিন্তিত হওয়ার মত কোন কারণ দেখছি না।”


“যখন সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়, তখনই তৈরি হয় বিপ্লবের জন্য জায়গা এবং এখানেও সেটিই ঘটেছে,” বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

Link copied!