অক্টোবর ১৩, ২০২২, ১১:১১ পিএম
রাজধানীতে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু ও আক্রান্ত দুটোই বেড়েছে আশংকাজনক হারে। এ অবস্থায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষে বলা হচ্ছে, এডিস মশা নির্মূল করা সম্ভব নয়। নগর কর্তারা বলছেন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড বা নেপালের চেয়ে এখনও রাজধানীর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগে. জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ভিয়েতনামে আজ পর্যন্ত ১ লাখ ৯৯ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। সিঙ্গাপুরে ৫০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪০ হাজারই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৩ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভালো আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ২৩ হাজার ২৮২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১৭ হাজার ২৫৯ জন ও ঢাকার বাইরে ৬ হাজার ২৩ জন। একই সময় সারাদেশে ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ২০ হাজার ৫০৪ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ১৫ হাজার ২৯৯ জন ও ঢাকার বাইরে পাঁচ হাজার ২০৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার ডেঙ্গুতে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর নতুন করে ৭৬৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। যা চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট ২ হাজার ৬৯৫ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৯১৫ জন ও ঢাকার বাইরে ৭৮০ জন।
এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশে ডেঙ্গু রোগী আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে বেশি আবার সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে বেশি হবে। এই সময়ে ডেঙ্গু রোগী বাড়বে, কারণ এটি এডিস মশার পিকজোন। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তা বলা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘চলতি বছরে বৃষ্টি কম হয়েছে, কিন্তু থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। থেমে থেকে বৃষ্টি আমাদের জন্য আশঙ্কার কারণ। এই বৃষ্টিতে মানুষের বাড়ির ছাদ বাগানে পানি জমে এবং সেখানে এডিস মশার জন্ম হয়। বর্ষাকালে টানা বৃষ্টিতে মশার ডিম পারার সুযোগ থাকে না।’
‘ডিএনসিসিতে মশা নিধনে সচেতনতার পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে লার্ভিসাইড স্প্রে ও এডাল্টিসাইড ফগার মেশিনে ওষুধ ছিঁটিয়ে এডিস মশা নির্মূল করা যাবে না। কারণ এডিস যে মশা ঘরে জন্মায়, আবার সেই ঘরের মানুষকেই কামড়ায়। সেজন্য মশারি টাঙিয়ে ঘুমানোর পাশাপাশি সন্তানদের ফুল সার্ট ও প্যান্ট পরিধান করতে হবে। এতে মশা কম কামড়ায় বলে জানান ডিএনসিসির এই কর্মকর্তা।’
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অ. দা.) ডা. ফজলে শামসুল কবির দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘মশা নিধনে গত এক মাসে সাতটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করেছি। চলতি সপ্তাহেও রাজধানীর বাসাবো এলাকায় ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করা হয়েছে। এছাড়াও যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, সেই সব এলাকায় সাথে সাথে মশার ওষুধ ছিঁটানো হচ্ছে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখন ডেঙ্গু রোগী নিয়ন্ত্রণে, এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দেশে প্রতিদিন যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দেখা যাচ্ছে, এর শতকরা দশভাগেরও কম ডেঙ্গুরোগী ডিএসসিসিতে। এখন পর্যন্ত ডিএসসিসি এলাকায় তিনজন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। তবে একটি মৃত্যুও আমাদের কাম্য নয়।’
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মশা মারার ওষুধ ছিঁটিয়ে এডিস মশা নির্মূল করা যায় না। কারণ এডিস মশা জন্মায় মানুষের ঘরের ভেতরে। সেখানে যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণ সচেতন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত শুধু সিটি করপোরেশন বা সরকারের পক্ষে এডিস নির্মূল সম্ভব না। কারণ বাড়ির ছাদ বাগানে এডিস মশার লার্ভা জন্মাচ্ছে। এসির পানিতে এডিস মশার লার্ভা জন্মাচ্ছে। প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে ঢোকা সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব নয়। জনগণকে সচেতন হতে হবে। তারা যেন বাসা-বাড়ি, ছাদ ও আঙ্গিনায় পানি জমতে না দেন। এটুকু কাজ যদি মানুষ ঠিকমতো করে, তাহলে আগামী সাত দিনের মধ্যে এডিস মশার কোনো প্রকোপ থাকবে না।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘এডিস মশা নির্মূলে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে একই দিনে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালাতে হবে। এতে কিছুটা হলেও এডিসার বংশবিস্তার ঠেকানো যাবে। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশন এখন পর্যন্ত যৌথভাবে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালায়নি। ফলে এডিস মশা বহাল তবিয়তে রয়েছে এবং ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত একযোগে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম না হবে ততদিন এডিস ডেঙ্গু ছড়াতে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষের লোকজন শুধু কথা দিয়ে লম্পঝম্প করে মশাকে মারতে চায়। কিন্তু সেটা আসলে সম্ভব না। এডিস মশা নির্মূলে সরকারি, বেসরকারি, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবি সংগঠ, স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীসহ দেশের সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালাতে হবে।’
ডেঙ্গু ভাইরাস চার ধরনের হয়। এবার চতুর্থ ধরনে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানান এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের শেষের দিকে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারিতে ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এতে ওই বছরে সারাদেশে ডেঙ্গুতে ২৮ হাজার ৪২৯ জন আক্রান্ত হয়েছিল। এরমধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।