দেশে মাথাপিছু খাদ্য অপচয় বছরে ৬৫ কেজি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ৭, ২০২২, ০৪:৫৩ পিএম

দেশে মাথাপিছু খাদ্য অপচয় বছরে ৬৫ কেজি

সারা দুনিয়াতে প্রতি বছর যত খাবার উৎপাদন হয় তার একটি বড় অংশ মাঠ থেকে আর খাবার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছায় না। সেটি অপচয় হয়ে যায়। আর খাদ্য অপচয়ের ক্ষেত্রে উন্নত, উন্নয়নশীল আর অনুন্নত কেউই বাদ যায় না।

বাংলাদেশে প্রতি বছর যত খাবার উৎপাদন হয়, তারও একটি বড় অংশ ভাগাড়ে যায়, মানে নষ্ট হয়।

জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউনেপ ২০২১ সালে ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স নামে রিপোর্ট প্রকাশ করে যাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে এক কোটি ৬ লাখ টন খাদ্য অপচয় হয়।

মাথাপিছু খাদ্য অপচয়ের হারও বাংলাদেশে বেশ বেশি।

ইউনেপের ওই ইনডেক্স অনুযায়ী একজন বাংলাদেশি বছরে ৬৫ কেজি খাদ্য উপাদান কিংবা তৈরি খাদ্য নষ্ট করেন।

কিন্তু বাংলাদেশের মত একটি দেশে খাবারের এত অপচয় কেন হয়? কিভাবেই বা সেটি ঠেকানো যাবে?
খাদ্য অপচয় বলতে কী বোঝায়?

ইউনেপ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় হয় চীনে। সেখানে বছরে খাদ্য অপচয়ের পরিমাণ ৯ কোটি ১৬ লাখ টন।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য অপচয় হয় বাংলাদেশে।

উৎপাদনের শুরু থেকে অর্থাৎ সেটি মাঠে শস্য উৎপাদন হোক কিংবা সবজি, ফল, মাংস, ডিম বা দুধ যাই হোক না কেন, সেটি মানুষের খাবারের প্লেটে যদি না পৌছায়, অথবা প্লেটে পৌঁছেও নষ্ট হয় তবে সাধারণভাবে তাকে খাদ্য অপচয় বলা যায়।

উৎপাদনের পর যদি সেটি খাওয়ার যোগ্য না হয়, মানে সেটি যদি পচে যায়, বা মান সম্পন্ন না হয়, সেটিও খাদ্য অপচয় বলে গণ্য হয়।

ইংরেজিতে বিষয়টি বোঝানোর জন্য 'ফুড লস' এবং 'ফুড ওয়েস্ট' দুইটি শব্দ ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু বাংলায় এ দুইটিকেই খাদ্য অপচয় বলে বর্ণনা করা হয়।

তবে 'ফুড লস' ফুড ভ্যালু চেইন বা খাদ্যচক্রের প্রাথমিক পর্যায়ে হয়ে থাকে আর 'ফুড ওয়েস্ট' হয় এই চক্রের শেষ প্রান্তে।

যখন শস্যদানা যেমন চাল-গম-ডাল, সবজি ও ফল, বিভিন্ন প্রাণীর মাংস, ডিম বা দুধ এসব উৎপাদনের পর বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে যেসব অপচয় হয় তাকে 'ফুড লস' বলে।

কিন্তু যখন এসব খাবার বাড়ি বা রেস্তোরাঁ বা কম্যুনিটি সেন্টারে রান্নার পর অপচয় হয় তখন সেটিকে 'ফুড ওয়েস্ট' বলা হয়।

দুই হাজার একুশ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও বাংলাদেশে একটি গবেষণা চালায় যাতে বলা হয়, বাংলাদেশে উচ্চ আয়ের পরিবারে বেশি খাদ্য অপচয় হয়।

ওই গবেষণা দলের প্রধান ছিলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান ।

তিনি বলেছেন, তাদের গবেষণায় তারা দেখতে পেয়েছেন উচ্চ আয়ের পরিবারে এক মাসে মাথাপিছু ২৬ কেজি খাদ্য অপচয় হয়।

তুলনায় মধ্য এবং নিম্ন আয়ের পরিবারে অপচয় কম হয়।
কিভাবে নষ্ট হয়?

অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেছেন, বাংলাদেশে কয়েকটি ধাপে খাদ্য অপচয় হয়।

তবে ফসলের ক্ষেত থেকে খাদ্যসামগ্রী বাজারে এসে পৌঁছানোর মধ্যবর্তী পর্যায়ে সবচেয়ে বড় অপচয়টি হয় বলে তিনি বলছেন।

এর মধ্যে ফসল তোলার পর্যায়ে এক ধরণের অপচয় হয়, এরপর মজুদ বা সংরক্ষণ করা এবং ব্যাপারীর মাধ্যমে সেটি বাজারজাত করার সময় আরেকবার অপচয় হয়।

এরপর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যখন বড় শহরে ফসল, সবজি ও ফল, মাংস, ডিম, বা দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আসে তখন আরেক দফায় অপচয় হয়।

কারণ হিসেবে অধ্যাপক হাসান বলেছেন, দেশে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কম, ফলে মাঠ থেকে ফসল তোলা, প্রক্রিয়াকরণ এবং মজুদ, তারপর সেগুলো বাজারে পরিবহন-এর প্রতিটি পর্যায়েই অপচয় হয়।

এফএও'র গবেষণায় দেখা গেছে, শস্যদানা মানে চাল, গম ও ডাল এসব উৎপাদন থেকে মানুষের প্লেট পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই প্রায় ১৮ শতাংশ অপচয় হয়।

ফল আর সবজির ক্ষেত্রে অপচয় হয় ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত।
বাংলাদেশে কেন মাথাপিছু খাদ্য অপচয় এত বেশি?

বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা এখন মধ্যম আয়ে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশে মাথাপিছু খাদ্য অপচয়ের যে হিসাব তা যথেষ্ট বেশি বলে মনে করেন গবেষকেরা।

অধ্যাপক হাসান মনে করেন, বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির কম ব্যবহার, সংরক্ষণের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকা, এবং বিকল্প সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকাই খাদ্য অপচয়ের প্রধান কারণ।

"কৃষক যদি তার উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ ঠিকমত না করতে পারে তাহলে তার ক্ষতি হবেই। ধরুন, কোল্ড স্টোরেজ না থাকার কারণে তাকে হয়তো শাক আজকেই বিক্রি করতে হবে, কিন্তু বিক্রি না হলে সেটা পুরো নষ্ট হয়ে গেল," তিনি বলেন।
কিভাবে ঠেকানো যাবে?

খাদ্যের অপচয়ের সাথে আরো অনেক অপচয় এবং ক্ষতি হয়।

এর মানে হচ্ছে উৎপাদনের পেছনে যে অর্থ লগ্নি করা হয়, যে পরিমাণ পানি ও জ্বালানি বিনিয়োগ করা হয়েছে, ফসল তোলা এবং পরিবহণ ও বাজারজাতকরণ এই প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রম ও অর্থ এবং প্রাকৃতিক শক্তির অপচয় হওয়া।

আর নষ্ট হওয়া খাবার জলবায়ু পরিবর্তনেও নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

এর মানে হচ্ছে চাহিদা পূরণে বেশি বেশি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যেতে হবে যা জমির উর্বরতা কমিয়ে দেয়।

আবার ভাগাড়ে ঠাঁই হওয়া ফেলে দেয়া খাবার পচে মিথেন গ্যাস তৈরি করে।

জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী ২০৭৫ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯৫০ কোটি।

এই বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য ভবিষ্যতে আরও খাদ্যের দরকার হবে।

শুধুমাত্র অপচয় বন্ধ করেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন গবেষকেরা।

অধ্যাপক হাসান বলেন, 'ফুড লস' ঠেকাতে কৃষি কাজে প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানো, সংরক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত করা, বিনিয়োগ বাড়ানো, কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে পুরো চক্রটির কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব।

তবে 'ফুড ওয়েস্ট' ঠেকাতে হলে বিশেষজ্ঞরা নানা রকম পরামর্শ দেন যাতে করে বাজার থেকে খাবার মানুষের পেটে যেতে পারে, ভাগাড়ে নয়।

এজন্য আগেভাগে পরিকল্পনা করে কেনাকাটা, রান্না, এবং পরিবেশনের কাজ করলে অপচয় কমে আসবে।

এক্ষেত্রে কয়েকটি পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করে দেখতে পারেন:

* চাহিদার তুলনায় বেশি কেনাকাটা না করার চেষ্টা করুন। আপনার কী প্রয়োজন তার একটি তালিকা করে বাজারে যান, তাহলে বাড়তি অর্থব্যয় এবং অপচয় কম হবে।

* খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে অপচয় কমে আসবে। অনেকেই জানেন না যে সবজি এবং ফলমূল কিভাবে সংরক্ষণ করতে হয়। যে কারণে তা দ্রুত পচে যায় বা খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়।

* উদ্বৃত্ত খাবার সংরক্ষণের উপায় জেনে নিন।

* ফেলে দেয়ার বদলে বিকল্প ব্যবহারের চিন্তা করতে পারেন। যেমন ফল বা সবজির খোসা, বেচে যাওয়া খাবার এসব দিয়ে বাড়িতেই জৈব সার তৈরি করা যায়।

Link copied!