এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি, লাগাতার ‘অসহযোগ কর্মসূচির’ ডাক আন্দোলনকারীদের

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ২১, ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম

এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি, লাগাতার ‘অসহযোগ কর্মসূচির’ ডাক আন্দোলনকারীদের

ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ‘সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঠিক তথ্য না দিয়ে প্রকৃত তথ্য আড়াল করেছেন’ অভিযোগ করে তার অপসারণ দাবি করেছে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’।

এনবিআর দুই ভাগ করা নিয়ে এ সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর গণমাধ্যমে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের দেওয়া বক্তব্য ‘মারাত্মকভাবে আহত করেছে’ বলেও পরিষদের নেতাদের ভাষ্য।

বুধবার, ২১ মে দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে ‘লাগাতার অসহযোগ’ কর্মসূচি পালনসহ নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তারা।

সরকার গত ১২ মে এনবিআরকে দুই ভাগ করার অধ্যাদেশ জারি করে। ওর বিরোধিতা করে এক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন এনবিআরের অধীন কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা।

এর ধারাবাহিকতায় বুধবার দুপুরে এনবিআর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতারা। সেখানে ওই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়ে নতুন কর্মসূচি তুলে ধরেন অতিরিক্ত কর কমিশনার হাসিনা আক্তার, শুল্কের উপ কমিশনার শাহাদাত জামিল শাওন এবং উপ কর কমিশনার মোহাম্মদ মোস্তফিজুর রহমান।

কর্মসূচি-

  • বুধবার প্রেস ব্রিফিংয়ের পর থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে ‘লাগাতার অসহযোগ কর্মসূচি পালন করা হবে;
  • এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের দাবিগুলোর বিষয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি দেওয়া হবে;
  • বৃহস্পতিবার এনবিআর এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিজ নিজ দপ্তরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। তবে, রপ্তানি ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এর আওতামুক্ত থাকবে;
  • শনিবার এবং রোববার কাস্টমস হাউস এবং এলসি স্টেশন ছাড়া ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সকল দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি চলবে। এই দুইদিন কাস্টমস হাউস এবং এলসি স্টেশনে সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে। তবে, রপ্তানি ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা কর্মবিরতির আওতামুক্ত থাকবে;
  • সোমবার থেকে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ছাড়া ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সকল দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি চলবে। 

লাগাতার কর্মসূচি ও অধ্যাদেশ বাতিলের দাবির মুখে মঙ্গলবার এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থ উপদেষ্টা।

অর্থ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে ওই বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা ছাড়া আরও দুজন উপদেষ্টা ছিলেন।

রাজস্ব সংস্কার পরামর্শক কমিটির সদস্যদের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তিন প্রাক্তন সদস্য ও এনবিআর চেয়ারম্যানও ছিলেন সেখানে।

বৈঠক বিষয়ে পরিষদের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “সভার শুরুতেই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমি মিটিং দীর্ঘ করব না। কর থেকে একজন এবং কাস্টমস থেকে একজন, সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটি থেকে যে কোনো তিনজন কথা বলতে পারবেন। আমি ৬-৭ মিনিটের বেশি দেব না। কেবিনেট সচিব এবং জনপ্রশাসনসচিব এর সাথে আরেকটি মিটিং আছে, আমি তাদের বসিয়ে রাখতে পারব না। সময় গণনার জন্য কে থাকবেন সেটাও জিজ্ঞাসা করেন।

“সভায় রাজস্ব সংস্কার পরামর্শক কমিটির সদস্যরা স্পষ্টভাবে বলেন যে, তাদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে যেভাবে সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে, তা জারিকৃত অধ্যাদেশে প্রতিফলিত হয়নি। কমিটির সদস্যরা বলেন, যদি তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে এবং জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। তারা দুটি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব এনবিআরের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই নির্ধারিত হওয়া উচিতএই বিষয়ে জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করেন।”

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, পরামর্শক কমিটির বক্তব্য শেষে দুইজন উপদেষ্টা বক্তব্য দেন, যা পরিষদকে হতাশ করেছে।

“আমরা আশা করেছিলাম যে, পরামর্শক কমিটির সম্মানিত সদস্যদের বক্তব্যের ধারাবাহিকতা সম্মানিত দুইজন উপদেষ্টার বক্তব্যের মধ্যে পাব। কিন্তু পরিতাপের সাথে আমরা জানাচ্ছি যে, তারা জারিকৃত অধ্যাদেশের পক্ষে কথা বলেন এবং অধ্যাদেশটি ভালো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।

“কোনটি সঠিক, কোনটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য, কোনটি দেশের জন্য সর্বোত্তম হবে সে বিষয়ে তারা কিছু বলেননি।”

সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে পরিষদ বলেছে, “মিটিং শেষে অর্থউপদেষ্টা মহোদয় একটা স্টেটমেন্ট মিডিয়ার কাছে দিয়েছেন। তার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, দেশের স্বার্থে, ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, দশের স্বার্থে যে অধ্যাদেশ অনুমোদন হয়েছে তা থাকবে, তবে আমাদের যে জিনিসগুলে আছে তা অ্যাডভাইজরি কমিটির সাথে আলোচনা করে বিধি বা অন্য কিছু করে অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করা হবে।

“তিনি বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা নয়’। আমাদের আন্দোলন চলবে কি চলবে না সে বিষয়ে কিছু আসে যায় না মর্মে তিনি মন্তব্য করেছেন।”

পরিষদ বলছে, “জুলাই বিপ্লব ফ্যাসিবাদ উত্তর যুগে মিটিং এ সরকারের নীতি নির্ধারকদের বক্তব্য এবং সভা শেষে মিডিয়ায় দেওয়া বক্তব্য আমাদেরকে মারাত্মকভাবে আহত করেছে।”

এনবিআর চেয়ারম্যানের বিষয়ে পরিষদের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “একটি বিষয় শুরু থেকেই আমাদের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে যে, আমাদের এই নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচির ব্যাপকতা ও যৌক্তিকতার বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান সরকারের নীতি নির্ধারকগণকে সঠিক তথ্য প্রদান না করে বরং প্রকৃত তথ্য আড়াল করেছেন, যা পরিস্থিতিকে আজকের অবস্থানে উপনীত করেছে।”

এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মিলিত ঐক্য পরিষদের দাবি

১. জারি করা অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে;

২. অবিলম্বে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে;

৩. রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসাধারণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে

৪. জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রস্তাবিত খসড়া এবং পরামর্শক কমিটির সুপারিশ আলোচনা-পর্যালোচনা করে প্রত্যাশী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের মতামত নিয়ে উপযুক্ত ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।

পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে এবারই প্রথম এনবিআরের সকল সদস্য এবং কমিশনাররা সম্পৃক্ত হন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কালো ব্যাজ পরতে দেখা যায়।

‘এনবিআর বাঁচলে বাঁচবে দেশ’; ‘সংস্কার হোক রাষ্ট্রের স্বার্থে’; ‘মধ্যরাতের অধ্যাদেশ রাজস্ব খাত করল শেষ’; ‘এনবিআর বিলুপ্তি নয় টেকসই সংস্কার চাই’; ‘চেয়েছিলাম সংস্কার করে দিল সৎকার’-সহ বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড দেখা যায় আন্দোলনকারীদের হাতে।

‘মধ্যরাতের কালো আইন বাতিল কর, করতে হবে’ শ্লোগানও শোনা যায় এ সময়।

এনবিআরকে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুই ভাগে আলাদা করতে গত ১৭ এপ্রিল খসড়া অধ্যাদেশে অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ।

অধ্যাদেশের খসড়া অনলাইনে এলে তা দেখে আয়কর ও শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। এই দুই ক্যাডারদের অ্যাসোসিয়েশন এটি বাতিলের দাবি তোলে।

এর মধ্যে এনবিআরকে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুই ভাগ করে ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার।

সেখানে বলা হয়, পরবর্তী সময়ে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার এটি কার্যকর করার তারিখ ঘোষণা করবে।

অধ্যাদেশের অনুচ্ছেদ ৪(৪) এ বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগের পদসমূহ আয়কর, কাস্টমস, ভ্যাট, অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন, গবেষণা, পরিসংখ্যান, প্রশাসন, অডিট, আইন সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পূরণ করা হবে।

রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে “কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতি মূল্যায়ন” যুক্ত করা হয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, রাজস্ব আহরণে অভিজ্ঞ কোনো সরকারি কর্মকর্তা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন।

রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদসমূহে আয়কর ও শুল্ক ক্যাডারের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে অধ্যাদেশে।

বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা রয়েছেন, যা তাদের নির্ধারিত পদ।

অধ্যাদেশে নীতির সচিব হিসেবে ‘উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে’ নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, এনবিআর বিলুপ্তির ফলে এর বর্তমান সাংগঠনিক জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে সংযুক্ত হবে। আর দুই বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামো কেমন হবে, তার সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানাবে।

এই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে প্রথম দফায় বুধবার, বৃহস্পতি ও শনিবার কলম বিরতি পালন করে ঐক্য পরিষদ। একই কর্মসূচি ছিল পরের দিনও। তারপর তৃতীয় দফায় সোমবারের কর্মসূচি বাড়ানো হয়।

তবে মঙ্গলবার অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক সামনে রেখে সোমবার আন্দোলন সাময়িক স্থগিতের ঘোষণা দেয় ঐক্য পরিষদ।   

Link copied!