ডিসেম্বর ৩, ২০২৫, ০১:৪৬ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, কিন্তু দেশে তুলনামূলকভাবে কমানো হয়নি। বরং বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মুনাফা বেড়েছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বিপিসি ৪ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা।
২০২৪ সালের মার্চে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মাসভিত্তিক জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়। তখন ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়। ওই সময় ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৫ ডলারের বেশি, যা অক্টোবরে নেমে আসে ৬৪ ডলারের কাছাকাছি—অর্থাৎ প্রায় ২৫ শতাংশ কমে। যদিও একই সময়ে ডলারের দাম ১১ শতাংশ বেড়েছে, তবুও সরকার ডিজেলের দাম কমিয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ।
জ্বালানি তেলে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য। বিপিসির হিসাবে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে শুল্ক–কর বাবদ সরকারের আয় হয়েছে ১৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। বিপিসি বছরে প্রায় ৬৮ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করে, যার ৬২ শতাংশ পরিবহন ও ১৫ শতাংশ কৃষি খাতে ব্যবহৃত হয়। আগের সরকারের সময়ে তেলের দাম বাড়ানোয় পরিবহন ভাড়া ও কৃষি উৎপাদন খরচ বাড়ে, ফলে দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি উভয়ই বেড়ে যায়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রত্যক্ষ কর আদায়ে ব্যর্থতা এবং বড় প্রকল্পে ব্যয়ের চাপে পড়ে সরকার জ্বালানি তেলকে রাজস্ব–নির্ভর খাতে পরিণত করেছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও তা এখনো ৮ শতাংশের ওপরে, যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি অনেকটাই কমিয়ে এনেছে। তাদের মতে, তেলের দাম কমালে পরিবহন খরচ ও উৎপাদন ব্যয় কমে ভোক্তা উপকৃত হতো।
সরকারি ব্যাখ্যা হচ্ছে—দাম কমালে প্রতিবেশী দেশে পাচারের ঝুঁকি বাড়তে পারে এবং বিপিসির মুনাফা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, বিপিসির মুনাফা দিয়ে নতুন তেল শোধনাগার তৈরির মতো উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে। বিপিসির নতুন শোধনাগার প্রকল্পটি ২০১২ সালে শুরু হয়; ২০১৫–১৬ সাল থেকে বিপিসি লাভ করতে শুরু করে এবং গত এক দশকে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপিসির অভ্যন্তরে চুরি, দুর্নীতি ও অদক্ষতা দূর করতে পারলে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুযোগ আছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা এম শামসুল আলম এক দশক আগে থেকেই বিপিসির আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার দাবি তুলেছেন, যা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও মূল্য সমন্বয়ের যে সূত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে স্বচ্ছতার অভাব আছে। বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম নির্ধারিত হলে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা কমানো সম্ভব হতো বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
দেশে বর্তমানে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১০৪ টাকা, পেট্রল ১২০ টাকা, অকটেন ১২৪ টাকা—এ মাসেই প্রতি লিটারে ২ টাকা করে দাম বাড়ানো হয়েছে। বিপিসি বলছে, তেল কিনে দেশে আসতে এক মাস সময় লাগে, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে দেশে দাম কমানো সম্ভব নয়।
বিশ্লেষকেরা তবে মনে করেন, সীমান্তে পাচারের অজুহাতে ভোক্তাকে বাড়তি দামে রাখার সুযোগ নেই, আর জ্বালানি তেলের মতো কৌশলগত পণ্য দিয়ে মুনাফা করাও গ্রহণযোগ্য নয়।