আগস্ট ১০, ২০২৩, ০৬:২০ পিএম
দেশের ১৭তম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে নাটোরের কাঁচাগোল্লা। গত ৮ আগস্ট শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) এক সভায় এ অনুমোদন দেয়।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানের স্বাক্ষরে নাটোর জেলা প্রশাসকের নামে কাঁচাগোল্লার জিআই স্বীকৃতির অনুমোদন দেওয়া হয়।
নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভুঞাঁ বলেন, ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা নাটোরবাসীর একটি গর্বের পণ্য। এটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় দেশে-বিদেশে কাঁচাগোল্লা আরও সমাদৃত হবে।’
প্রায় ২৬৩ বছর পর সুস্বাদু মিষ্টান্ন কাঁচাগোল্লার ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন নাটোরের সাবেক ও রাজশাহীর বর্তমান জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ।
জানতে চাইলে শামীম আহমেদ বলেন, ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় আমি আনন্দিত। এজন্য বেশি কাজ করেছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাদিম সারোয়ার।’
গত ৩০ মার্চ এফিডেভিটের মাধ্যমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) মাধ্যমে নাটোরের কাঁচাগোল্লার জিআই আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি কাঁচাগোল্লার মূল কারিগর মধুসূদন পাল। তিনি বেঁচে নেই কিন্তু এখনো দেশ-বিদেশজুড়ে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টির কদর রয়েছে।
অর্ধ বঙ্গেশ্বরীখ্যাত নাটোরের রাণী ভবানীর প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল এই মিষ্টি। তাঁর রাজপ্রাসাদে নিয়মিত মিষ্টি সরবরাহ করতেন শহরের লালবাজারের মিষ্টি বিক্রেতা মধুসূদন পাল।
একদিন মিষ্টি বানানোর কর্মচারীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদিকে মিষ্টি তৈরির জন্যে দুই মণ ছানা সংগ্রহ করা ছিল। সেগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ছানার সাথে চিনি মিশিয়ে উনুনে তাপ দেন মধুসূদন। কারিগর ছাড়াই এলোমেলো এই আয়োজনে তৈরি হয় নতুন এক মিষ্টি। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় নতুন এই মিষ্টিই পাঠিয়ে দেন রানি ভবানীর রাজবাড়িতে।
রানি ভবানী এই মিষ্টি খেয়ে প্রশংসা করেন এবং এর নাম জানতে চান। মধুসূদন পাল তখন কাঁচা ছানা থেকে তৈরি বলে এর নাম দেন কাঁচাগোল্লা। এই হচ্ছে কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির ইতিহাস। এই গল্প বেঁচে আছে শত-শত বছর ধরে মানুষের মুখে- মুখে।
তবে এই জনশ্রুতি নিয়ে নাটোরের ইতিহাসপ্রণেতা সমর পাল বলেন, ‘বলা হয়, রানি ভবানীর সময়ে মধুসূদন পাল কাঁচাগোল্লার উদ্ভাবক। আমার পূর্বপুরুষরা মূলত নাটোর শহরের প্রথম মিষ্টি ব্যবসায়ী। লালবাজার ও নিচাবাজারে আমাদের স্বজনরাই বিরাট জায়গাজুড়ে ব্যবসা করতেন। রানি ভবানী মারা যান ১৮০২ সালে, আর মধুসূদন পালের জন্ম ১৮৮৫ সালে। ফলে এই জনশ্রুতির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।’
কাঁচাগোল্লা নিয়ে আরেকটি জনশ্রুতি হলো, নাটোর রাজের বড় তরফের রাজা গোবিন্দ্রনাথের স্ত্রী ব্রজসুন্দরীর দত্তকপুত্র মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮-১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ) একটু খেয়ালি প্রকৃতির ছিলেন। এক রাতে মিষ্টি খাওয়ার বায়না ধরেন তিনি। কিন্তু এত রাতে কোথায় পাওয়া যাবে মিষ্টি?
ডাকা হয় রাজার মিষ্টি তৈরির কারিগরকে। কীভাবেই বা মিষ্টি তৈরি হবে? কারিগর তখন দুধ সংগ্রহ করে ছানা তৈরি করলেন। এরপর কড়াইয়ে জল-চিনি মিশিয়ে উনুনে কিছুক্ষণ জ্বাল দিলেন। পরে তাতে ছানা ঢেলে দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল সুস্বাদু এক নতুন মিষ্টি।
মহারাজা তা খেয়ে দারুণ খুশি। এমন স্বাদের মিষ্টির নাম জানতে চাইলেন তিনি। কোনো কিছু না ভেবেই কারিগর বললেন ‘কাঁচাগোল্লা’।
এক মণ দুধ থেকে সাত থেকে সাড়ে সাত কেজি ছানা হয়। তারপর সেই ছানা চুলা থেকে নামিয়ে কাপড়ে পেঁচিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। দিনভর ধীরে ধীরে ছানার পানি নেমে যায়। তারপর শুকনা অবস্থায় সেই ছানা নিয়ে মধ্যরাত থেকে শেষ পর্যায়ের কাঁচাগোল্লা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কারিগররা। ওজন দিয়ে প্রথমে হাত দিয়ে ছেনে ছানা মিহি করে নেন তারা।
তিন কেজি চিনি ও তরল দুধের সাথে মিহি করা সাত কেজি ছানা আবারও গনগনে চুলায় জ্বাল দেয়া হয়। ১ কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে প্রায় ১ কেজি কাঁচা ছানা ও ৪০০ গ্রাম চিনির প্রয়োজন হয়।
৪০ থেকে ৪৫ মিনিট জ্বাল দেবার পর তা চুলা থেকে নামিয়ে ঠাণ্ডা করা হয়। এভাবে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টার প্রক্রিয়া শেষে তৈরি হয় নাটোরের কাঁচাগোল্লা।
ছানা আর চিনির সংমিশ্রণে এক প্রকার সন্দেশের মতো দেখতে এই মিষ্টির নাম কাঁচাগোল্লা নাম হলেও এই মিষ্টি কিন্তু দেখতে গোল হয় না। দারুণ স্বাদের জন্য এই মিষ্টি সারাদেশেই বেশ জনপ্রিয়। এমনকি পার্শ্ববতী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেও এই মিষ্টির জনপ্রিয়তা রয়েছে।