ফেডারেল রিজার্ভ কী? মার্কিন প্রেসিডেন্ট কি এতে হস্তক্ষেপ করতে পারেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগস্ট ২৬, ২০২৫, ০১:২১ পিএম

ফেডারেল রিজার্ভ কী? মার্কিন প্রেসিডেন্ট কি এতে হস্তক্ষেপ করতে পারেন?

ছবি: সংগৃহীত

আগে যা কেউ ভাবেনি, করেনিসেই কাজেই যেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষত্ব। মার্কিন রাজনীতির মঞ্চে তিনি প্রায়ই চমক নিয়ে হাজির হন। এবারও হলো তাই। হোয়াইট হাউস থেকে হঠাৎ ঘোষণা এলোফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডের তথা ফেডের গভর্নর লিসা কুককে বরখাস্ত করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অভিযোগ, মর্টগেজের কাগজপত্রে তিনি প্রতারণা করেছেন।

কিন্তু এখানেই কাহিনির নাটকীয় বাঁক। কারণ ফেডারেল রিজার্ভ কোনো সাধারণ দপ্তর নয়এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে স্বাধীন ও প্রভাবশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর গভর্নরদের চাকরির মেয়াদ এত দীর্ঘ যে এক প্রেসিডেন্টের আমল শেষ হলেও তারা দায়িত্বে থেকে যান। ফলে, ১১১ বছরের ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্টই আগে সাহস করে ফেড গভর্নরকে সরাননি। ট্রাম্পের পদক্ষেপ তাই এক কথায় নজিরবিহীনএবং তা নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক।

ফেডারেল রিজার্ভ আসলে কী?

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (Fed) ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো

·         মুদ্রানীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন

·         মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

·         ব্যাংকিং ব্যবস্থা তদারকি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা

·         আর্থিক সংকটে জরুরি সহায়তা দেওয়া।

ফেড নিজস্ব বাজেট থেকে পরিচালিত হয়, প্রেসিডেন্ট বা কংগ্রেসের সরাসরি অর্থায়নের ওপর নির্ভর করে না। ফলে এর স্বাধীনতা অন্য অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি।

ফেডের গভর্নররা কীভাবে নিয়োগ পান?

ফেডের বোর্ডে সাতজন গভর্নর থাকেন। তাদের নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট, তবে সিনেটের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। প্রতিটি গভর্নরের মেয়াদ দীর্ঘ১৪ বছর। কারও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অন্য কেউ দায়িত্ব নিলে, সেই সদস্য কেবল অবশিষ্ট সময়টুকু পূরণ করেন। মেয়াদ পূর্ণ হলেও নতুন কেউ নিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারেন।

এই কাঠামো এমনভাবে তৈরি যে, কোনো এক প্রেসিডেন্ট তার মেয়াদকালে পুরো বোর্ডকে বদলে দিতে না পারেন। এভাবেই ফেডকে রাজনৈতিক চাপমুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট কি গভর্নরকে বরখাস্ত করতে পারেন?

আইন অনুযায়ী, “for cause” অর্থাৎ “কারণ দেখিয়ে” ফেড গভর্নরকে সরানো সম্ভব। কিন্তু সেই “কারণ” কী হতে পারে, তার সংজ্ঞা অস্পষ্ট। সাধারণত গুরুতর দায়িত্বে অবহেলা, অসদাচরণ বা সরকারি কাজে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকেই “cause” হিসেবে গণ্য করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কুকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছেতা তার নিয়োগের আগের বিষয় এবং সিনেট অনুমোদন প্রক্রিয়ায় জানা ছিল। তাই প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমা এখানে আইনত প্রশ্নবিদ্ধ।

অতীতে কোনো নজির আছে কি?

ফেড প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো প্রেসিডেন্টই কোনো গভর্নরকে বরখাস্ত করেননি।

১৯৭০-এর দশক থেকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্টরা ফেডের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছেন।

প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের সময় (১৮৩০-এর দশকে) মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই হয়েছিল, তবে তখন ফেডের বর্তমান কাঠামোই গড়ে ওঠেনি। এর বাইরে ফেড গভর্নর বরখাস্তের কোনো দৃষ্টান্ত নেই। সুতরাং ট্রাম্পের পদক্ষেপ একেবারেই নজিরবিহীন।

কুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও প্রতিক্রিয়া

অভিযোগ: তিনি দুটি আলাদা বাড়ির মর্টগেজ আবেদন করার সময় উভয় ক্ষেত্রেই সেটিকে ‘প্রধান বাসস্থান’ হিসেবে দেখান, যা আইনবিরুদ্ধ।

ট্রাম্প বলেন, এ ঘটনায় “প্রতারণা” হয়েছে এবং তার সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

জবাবে কুক বলেছেন, প্রেসিডেন্টের কোনো আইনি ক্ষমতা নেই তাকে বরখাস্ত করার, কারণ এ ধরনের অভিযোগ “for cause” সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। তিনি আদালতে লড়বেন এবং পদ ছাড়বেন না।

এই ঘটনার সম্ভাব্য প্রভাব

আইনি লড়াই: আদালতে গেলে মার্কিন সংবিধান ও ফেডারেল রিজার্ভ অ্যাক্টের ব্যাখ্যা নতুনভাবে আলোচিত হবে।

ফেডের স্বাধীনতা প্রশ্নে: এত দিন ধরে যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি গড়ে উঠেছিল, তা এখন বড় পরীক্ষা দিতে পারে।

আর্থিক বাজারে আস্থা: অর্থনীতিবিদরা বারবার বলেছেনফেড যদি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকে, তবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নীতিনির্ধারণ কার্যকর হয়। প্রেসিডেন্টের এ ধরনের পদক্ষেপ সেই আস্থাকে নাড়িয়ে দিতে পারে।

লিসা কুককে ঘিরে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও আর্থিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ এখন শুধু অর্থনৈতিক নীতি নয়, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমা ও আইনি কাঠামো নিয়েও বিতর্কের কেন্দ্রে। আদালতের রায় কী হবে তা এখনও অনিশ্চিত, তবে এতটুকু নিশ্চিতএই ঘটনা ভবিষ্যতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও প্রেসিডেন্টের সম্পর্ক নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।

Link copied!