ঢাবির খাবার : অনাবাসিক ছাত্রীদের দুঃস্বপ্ন

মাহমুদ নকীব

ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৪, ১১:০২ পিএম

ঢাবির খাবার : অনাবাসিক ছাত্রীদের দুঃস্বপ্ন

প্রতীকী ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শেখ অহোনা। গত দুইবছর ধরে মিরপুর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করছেন।

শুক্র ও শনিবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি পাঁচ দিন ক্লাস থাকায় স্বভাবতই সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে দুপুরের খাবার বেশিরভাগ সময় ক্যাম্পাস আঙিনাতেই সম্পন্ন করতে হয়। কোনো প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান করতে হলে ক্যাম্পাসেই সারতে হয় রাতের ভোজ। 

তবে এই সারাবেলা ক্যাম্পাসের খাবার খাওয়ার বিষয়ে অহোনাদের অসন্তোষ চরমে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে যেসব ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়টি আবাসিক হলে থাকে না, তাদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানসম্মত খাবার পাওয়া একরকম দুষ্কর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে নিজের আক্ষেপের কথা জানান শেখ অহোনা। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে কোনো ভালো খাবারের জায়গা নেই। অনেক দূর থেকে আসতে হয় বলে সকালে বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসা সম্ভব হয় না সবসময়।

তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, নিজের হলে অনাবাসিকদের প্রবেশও নিষেধ। হলেও খেতে যেতে পারি না। হয় ভাজাপোড়া না হয় তৈলাক্ত খিচুড়ি কিংবা ফ্রাইড রাইসজাতীয় খাবার খেতে বাধ্য হই। অনেক সময় খাবারও পাই না। এতে তো ক্যাম্পাস লাইফে সুস্থ থাকাটাই অনেক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত থাকতে থাকতে নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন বলে জানান অহোনা।  তিনি বলেন, নিম্ন রক্তচাপের সমস্যায় পড়ে যাই মাঝে মধ্যেই। ওজন তো দিনে দিনে কমছেই। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে গিয়েছে অনেক।

অহোনা দাবি করেছেন, ২০২২ সালে প্রথম বর্ষে যখন তিনি ভর্তি হন তখন তার ওজন ছিল ৫২ কেজি। বর্তমানে ৮ কেজি কমে তার ওজন দাঁড়িয়েছে ৪৪ কেজিতে।

সে ডাক্তার দেখালে, ডাক্তার তাকে বলেছে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে সে। তার খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দেন সেই চিকিৎসক, যোগ করেন অহোনা।

তিনি আরও যুক্ত করেন, ‍‍‘বেশিরভাগ সময়ই খাওয়া হয় ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনের খাবারের দোকানে। এদিকে কলাভবন ক্যাফেটেরিয়া (ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া), টিএসসি ক্যাফেটেরিয়াতে একটু দেরি করলেই খাবার পাওয়া যায় না। কম টাকায় শিক্ষার্থীদের অনেকের সাধ্যের মধ্যে একটু ভাল মানের খাবার ক্যাম্পাসে নেই বললেই চলে।‍‍’

সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় পাঠাগারের সামনের দোকানে, হাকিম চত্বরের দুটি দোকান, চারুকলার ক্যান্টিন, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ক্যান্টিন, গণিত ভবন, পুষ্টি বিজ্ঞানের ক্যান্টিন, টিএসসি ও কলাভবন ক্যাফেটেরিয়ায় বাজেটের মধ্যে খাবার খেতে পারেন নারী শিক্ষার্থীরা। 

আর আইবিএ ক্যান্টিন, এফবিএস ফুডকোর্ট এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে কফি হাটে ফ্রাইড রাইস, বার্গারসহ নানা রকমের ফাস্ট ফুড পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলোর দাম তুলনামূলক বেশি।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কলাভবন ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারের মেন্যুতে আছে ভাত, ডাল ও ছোট এক টুকরো মুরগির মাংস, যার দাম ২০ টাকা, আর কফি হাটে ফ্রাইড রাইস ও ভেজিটেবলের প্যাকের দাম ১৪০ টাকা। 

এছাড়া ছেলেদের দুই-একটি আবাসিক হল যেমন জগন্নাথ হল, জসীমউদ্দীন হলের ক্যাফেটেরিয়ায় খাবার খেতে পারেন নারী শিক্ষার্থীরা। 

তবে হলগুলোতে গিয়ে খেয়ে ফিরতে ফিরতে অনেক সময় ক্লাসে দেরি হয়ে যায় বলে জানাচ্ছেন অনেক অনাবাসিক ছাত্রীরা। আবার ক্লাস যদি ১টায় শেষ হয়, তবে ক্লাস শেষ করে খেতে গিয়ে যে খাবার ছাত্রীরা পাচ্ছেন তা তলানির দিকের।

আইডি কার্ড দেখিয়েও নিজ হলের ক্যান্টিনে যেতে পারেন না অনাবাসিক ছাত্রীরা

বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাবাসিক ছাত্রীরা যারা মেয়েদের পাঁচটি হলের যেকোনো একটিতে সংযুক্ত, তারা নিজেদের অনাবাসিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে সর্বোচ্চ নিজের হলের প্রশাসনিক অফিস পর্যন্ত যেতে পারেন। এর বাইরে ক্যান্টিনে বা অন্য কোথাও তাদের প্রবেশাধিকার নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের প্রভোস্ট ড. লাফিফা জামাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে অনাবাসিক ছাত্রীরা অফিস, গেস্টরুম, নামাজের জায়গায় যেতে পারে। তারা প্রয়োজনে কাউকে দিয়ে খাবার এনে নিতে পারে, কিন্তু ক্যান্টিনে যাওয়ার নিয়ম নেই।

কেন অনাবাসিক ছাত্রীরা হল ক্যান্টিনে বা হলের অভ্যন্তরে যেতে পারেন না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আমাদের এইসব নিয়ে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন- মেয়েরা হলে ঢুকলে আর বের হয় না। এসব বিষয় নিয়ে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরাও অভিযোগ জানিয়েছেন। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে অনাবাসিক নারী শিক্ষার্থীদের হলের অভ্যন্তরে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

ছেলেদের হল ক্যান্টিনে সুযোগ থাকলেও “অস্বস্তিবোধ” করছেন ছাত্রীরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নুসরাত জান্নাত তালবিয়া দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে তার অসন্তোষের কথা জানান।

তিনি বলেন, ছেলেদের জসিমউদ্দীন ও জগন্নাথ হলে মেয়েরা খাবার খেতে পারলেও সেখানে যেতে অস্বস্তিবোধ হয় এবং হল দুটি বেশ দূরেও।

এছাড়া ক্যাম্পাসের সার্বিক খাবারের চিত্র নিয়ে তিনি বলেন, দুপুরে ক্লাস থাকলে প্রায় সময়ই ডাকসুতে (কলাভবন ক্যাফেটেরিয়া) খেতে হয়। কারণ আমাদের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভবনে কোনো ক্যান্টিন নেই। ডাকসুর ২০ টাকার খাবার খেয়ে পেট ভরে না, পুষ্টিও পাই না। 

মোটামুটি একটু ভালো কিছু খেতে হলে যেতে হয় চারুকলা অথবা আইইআর ক্যান্টিন। যা আমাদের জন্য দূর হয়ে যায়। দূরে গিয়ে খেতে গেলে ক্লাসে আসতে দেরি হয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করতে হয়, এতে খাবার ভালোভাবে খাওয়া যায় না। আর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে কফি হাটের খাবার ওভারপ্রাইজড (বেশি দাম)।

এক্ষেত্রে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ভালো মানের ক্যান্টিন প্রয়োজন বলে জানান নুসরাত। 

কলা অনুষদের তাবাসসুম তানহা হৃদি নামের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসে বলতে গেলে পুরোদিনই থাকতে হয়। সকাল আর দুপুরের খাওয়া ক্যাম্পাসেই। গত একবছরে এই খাবার খেয়েই স্থায়ী অসুস্থতা বাঁধিয়ে ফেলেছি। দুপুরে তো সেই দুই-আইটেমই। রাইস আর খিচুড়ি। আর সকালে ভাজাপোড়া আইটেম। 

দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে খাবারের এই অবস্থা নিয়ে কারো কোনো কর্ণপাত নেই বলেও অভিযোগ করেন হৃদি। 

 “ক্যাম্পাসের খাবারের পুষ্টিমান একেবারে কম” – পুষ্টিবিদ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

অনাবাসিক ছাত্রীদের খাবারের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদুল আরিফিনের সাথে। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবারের সার্বিক চিত্র মোটেও ভালো না। ক্যাম্পাসের খাবারের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে দুটি বিষয়- প্রথমত, খাবারের মান ভালো না। খাবারের পুষ্টিমান একেবারেই কম। দেখা যায় একজন মানুষের দৈনিক যে পরিমাণ আমিষ প্রয়োজন সে তুলনায় ক্যান্টিনগুলোর খাবারের অনেক বেশি ঘাটতি দেখা যায়। ফ্যাটের ঘাটতি না হলেও দেখা যায় যে সমস্ত ফ্যাট আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর সেগুলোই ছাত্রীদের খেতে হচ্ছে। এছাড়া ক্যান্টিনের পচা-বাসি খাবারগুলোর মধ্যে বিদ্যমান মাইক্রো-বায়োলজিক্যাল সাইডগুলো শিক্ষার্থীদের অসুস্থ বানিয়ে দিচ্ছে। সেখানে হাইজিন মেইনটেইন (স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা) হয় না।

খাবার সংকট বিষয়ে কর্তৃপক্ষ অবহিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাবাসিক ছাত্রীদের খাদ্য সংকট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, খাবার নিয়ে সংকটের কথা আমরা জানতে পেরেছি। খাবারের দাম ও মান আমরা প্রক্টরিয়াল টিমকে পাঠিয়ে খবর নিব। ছাত্রীদের অসুবিধার বিষয়টি দেখা হবে। 

এছাড়াও নারী আবাসিক হলগুলোতে খাবার সুযোগ করে দেয়া যায় কিনা সেটি নিয়েও খোঁজখবর নিবেন বলে দ্য রিপোর্ট লাইভকে আশ্বস্ত করেন ঢাবি উপাচার্য। 

Link copied!