সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৩, ০২:৩০ এএম
বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে- ছোট্ট বেলায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা সংকল্প কবিতার লাইনগুলো নাড়া দিয়েছে সকল শিশুকে। কবির মতো কতোজনেই তো চেয়েছেন বিশ্বকে মুঠোয় পুরতে— পেরেছেন কি?
কল্পনাতে বিশ্বকে হাতের হাতের মুঠোয় পুরতে পারলেও বাস্তবে এর জন্যে প্রয়োজন ছিল কানেকটিভিটির। এই কানেকটিভিটি বা সংযোগ সম্ভব হয়েছে ইন্টারনেটের আবিষ্কারের ফলে। অবশ্য, ব্যাপকহারে ইন্টারনেটের সুফল পেতে বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। তবে, প্রাথমিকভাবে এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে আবির্ভাব সাইবার ক্যাফেগুলোর।
প্রায় প্রতিটি জেলা ও বিভাগীয় শহরের প্রাণকেন্দ্রের কোনো এক দোকানের ভেতরে দেখা মিলত ছোট ছোট খুপরি। তিন পাশে কাঠ কিংবা কাঁচের বেষ্টনি দেওয়া সেসব খুপরির ভেতরে সেট করা থাকতো ইন্টারনেট সংযুক্ত কম্পিউটার। তারসাথে যুক্ত থাকতো হেডফোন, ওয়েব ক্যাম, প্রিন্টার, স্ক্যানারসহ যাবতীয়সব জিনিসপত্র। নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেওয়া প্রতিটি মানুষ শিশুকালেই এই খুপরি আর এর ভেতরের কম্পিউটারের সাথে পরিচিত হয়েছে।
সেসময়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে সকল স্তরের মানুষের আনাগোনা ছিল এই খুপরিগুলোতে। কেউ আসতো কাগজপত্র তৈরির জন্যে, কেউ আবার ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিশ্বের সাথে পরিচিত হতে। প্রিয় গান শোনা, সিনেমা দেখা কিংবা ব্রাউজিং করার লোকেদের সংখ্যাই বেশি ছিলো এই সাইবার ক্যাফেগুলোতে। এসবেরই সুযোগ পেতো নামমাত্র মূল্যে!
যাইহোক, এই খুপরিগুলোই বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসা সাইবার ক্যাফে! এখানে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে একটি জেনারেশনের স্মৃতি— এই ঘরগুলো দেখলে নব্বইয়ের শিশুরা নস্টালজিক হয়ে উঠেন এখনও।
তবে এ শতকের মানুষের কাছে এই সাইবার ক্যাফের আবেগ ততটা তীব্র নয়। ইন্টারনেট ও কম্পিউটার এখন সকলের হাতে হাতে, তাই এর সাথে ঠিকঠাক পরিচয়ও হয়ে ওঠেনি একুশ শতকের শিশুদের। বিস্মৃত নগরীর ইতিহাস লিখলে যেটি বারবার অবর্ণনীয়ই থেকে যাই সেই স্মৃতিকেই আরও একবার রোমন্থন করার সুযোগ তৈরির এই প্রয়াস।
বাংলাদেশে সাইবার ক্যাফের যাত্রা
বিশ্ব সাইবার ক্যাফে ধারণাটির সাথে অনেক আগে পরিচিত হলেও বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। ডলচে ভিটা নামে রাজধানীর বনানীতে শুরু হলো সাইবার ক্যাফের প্রথম ঘর। দেশের মানুষকে এই ধারণার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দিতে হয় মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব আক্কু চৌধুরীকে।
১৯৯৯ সালে আক্কু চৌধুরী শুরু করলেন দেশের প্রথম সাইবার ক্যাফে। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডলচে ভিটা সাইবার ক্যাফে’। এই ক্যাফের সাথে সাথে বাংলাদেশ প্রবেশ করে অনিন্দ্য সুন্দর এক যুগে।
প্রায় সমসাময়িককালেই ধানমন্ডিতে চালু হয় ব্লু প্ল্যানেট সাইবার ক্যাফে, এরপর একে একে সাইবার ক্যাফের ধারণাটি ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারিদিকে। এই ক্যাফের মালিক ছিলেন আরিফুল হক।
সাইবার ক্যাফে হতে হলে
কেউ যদি একটি কিংবা দুটি কম্পিউটার নিয়ে মানুষকে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে থাকেন তবে তা সাইবার ক্যাফে হিসেবে পরিগণিত হবে না। প্রশ্ন উঠতেই পারে, কত পরিসরে এই সুবিধা দিলে সাইবার ক্যাফের তকমা পাবে একটি প্রতিষ্ঠান? সেই জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটাবে কে? অবশ্যই সাইবার ক্যাফের সাথে যুক্ত আছেন এমন মানুষই ঠিক করবেন। সাইবার ক্যাফে ওনার্স এসোসিয়েশনের নেতারা বসে ঠিক করলেন ৬ থেকে বেশি কম্পিউটার থাকলে তা সাইবার ক্যাফে হিসেবে পরিগণিত করেন।
তবে, সময় বদলায়। সময়ের সাথে অনেক কিছুর শর্তেও আসে শিথিলতা। সাম্প্রতিককালে এই ক্রাইটেরিয়া শিথিল করে নামিয়ে আনা হয়েছে চারটিতে।
স্মৃতিতেই বেঁচে আছে এই ক্যাফে
বর্তমানে হাতে হাতে স্মার্টফোনের যুগে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে এসব ক্যাফে। শহরে পূর্ণ সাইবার ক্যাফে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
সাইবার ক্যাফে নিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করলে শখানেক ফলাফল আসে। তবে, সাইবার ক্যাফের লোকেশনে গিয়ে দেখা যায় সেগুলো এখন আর সাইবার ক্যাফে নেই। এখন কাজ করছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে। কিংবা, শুধু সাইনবোর্ডটিই ঝুলছে ভেতরে চলছে অন্য কোন ব্যবসা।
মোহাম্মদপুর হাউজিং বিল্ডিং সোসাইটিতে দেখা মিলবে একটি বহুল কাঙ্খিত সাইবার ক্যাফের। যার নাম ‘টেট্রাসফট’।
দেখে বোঝা যায় মালিক কতটা সংগ্রাম করছেন তা টিকিয়ে রাখতে। সাইবার ক্যাফের একপাশে কাপড়ের দোকান দিয়েছেন মালিক জুলফিকার হায়দার। যেই পাশে এই সাইবার ক্যাফেটি রয়েছে তার একাংশে আবার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের ব্যবসা।
এক কালে ফার্মগেটের মাহবুব প্লাজায় ছিল বেশ কয়েকটি সাইবার ক্যাফে। সেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় ব্যবসাও ছিলো জমজমাট। তবে, বর্তমানের আর তার ছিটেফোটাও নেই। টিকে আছে কেবল একটি প্রতিষ্ঠান ‘ডিজিটেক সাইবার ক্যাফে’। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে আরো গুটিকতক ক্যাফে।
সাইবার ক্যাফে থাকলেও এখন সেই অর্থে মানুষের আনাগোনা নেই সেই সাইবার ক্যাফে ঘিরে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা পড়ুয়া দু-চারজন আসেন। যাদের বাসায় কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারে কড়াকড়ি রয়েছে তারাই কেবল আসেন এই ক্যাফেগুলোতে। তাদের কেউ আসেন গেমস খেলতে তো কেউ আসেন ব্রাউজিং করতে। এমন গুটি কয়েক কাস্টমারকে পুঁজি করেই টিকে আছে এক সময়ে ইন্টারনেট জগতে যুক্ত হবার প্রধান অনুষঙ্গ।
নগরী জুড়ে এমন কয়েকটি ক্যাফে এখনো সচল থাকলেও ক্রমহ্রাসমান চাহিদার কারণে এগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনাই বেশি। ভবিষ্যতে হয়তো এগুলো টিকে থাকবে আমাদের স্মৃতিতেই…।