ভয়াল ২১ আগস্ট: সেদিন হামলার একমাত্র টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা

ফারুক আলম

আগস্ট ২১, ২০২২, ০৬:১৫ এএম

ভয়াল ২১ আগস্ট: সেদিন হামলার একমাত্র টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা

দেশের ইতিহাসে বর্বোরিচত যেসব রাজনৈতিক হামলার ঘটনা ঘটেছে, ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা সেগুলোর মধ্যে শীর্ষতম। ইতিহাসের জঘন্যতম ওই গ্রেনেড হামলার ১৮ বছর আজ। আঠারো বছর আগের এ দিনে গ্রেনেড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠেছিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। ছিন্নবিছিন্ন হয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দেহ, রক্তে ভিজে গিয়েছিল রাজপথ। স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল গোটা দেশ। সমালোচনার ঝড় উঠেছিল দেশ-বিদেশে। সেদিনের নারকীয়তায় প্রাণপাত হয়েছিল ২৪ জনের। আরও অসংখ্য মানুষ হয়েছিলেন গুরুতর আহত। অনেকে পরে মারাও গেছেন গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে নিয়ে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে চালানো হয় ওই গ্রেনেড হামলা। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ওই হামলার ছক কষা হয়েছিল। হামলার মূল টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা। সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে যান। দলের নেতাকর্মীরা মানব বর্ম তৈরি সেদিন তাঁকে রক্ষা করেছিলেন।

বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার তখন ক্ষমতায়। সেই সময়ই গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল। আওয়ামী লীগ বলছে, পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পশ্চিম পাকিস্তান সেই পরাধীনতার গ্লানি মানতে না পেরে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে। বাংলার মাটিতে বসে এখনো পাকিস্তানের শুভাকাঙ্খীরা ওই ষড়যন্ত্রটি করে। বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ নামের দলটি মুছে ফেলার নীল নক্শা তৈরি করা হয়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশ-বিদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে আওয়ামী লীগকেও নেতৃত্বশূন্য করতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাটি চালানো হয়।

গ্রেনেড হামলার পাশাপাশি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে তাঁর গাড়িতে সেদিন ছয়টি গুলিও ছোঁড়া হয়েছিল। ওই সময়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও চিরদিনের জন্য শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর। হামলায় ঘটনাস্থলেই ১৬ নিহত হন। পরে সব মিলে ২৪ জন নিহত হন।

ভয়াল ওই গ্রেনেড হামলায় প্রয়াত হন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও দলের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান। এ ছাড়াও নিহত হন ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, হাসিনা মমতাজ রিনা, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসির উদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। 

২৪ জন নিহত হওয়া ছাড়াও শতশত নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। তদের মধ্যে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি (তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য) জিল্লুর রহমান, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, ঢাকার সাবেক মেয়র (প্রয়াত) মো. হানিফ, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা আখতার, অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজলসহ সাধারণ মানুষ রয়েছেন।

সমাবেশে আসা নেতাকর্মীরা বুঝে ওঠার আগেই একের পর এক গ্রেনেড বিকট বিস্ফোরণ হয়। হামলায় ঘটনাস্থলে নেতাকর্মীদের দেহ ছিন্নবিছিন্ন হয়। রক্তের স্রোত বয়ে যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে। এক ধরনের মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। তবে ওই ঘটনার পর মুহূর্তে হামলার খবর দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক মহল থেকে চাপ আসে ক্ষমতাসীন দল বিএনপির ওপর। তখনই প্রকৃত ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে ‘জজ মিয়া’ নাটক মঞ্চায়ণ করা হয়।  ২০০৫ সালের জুনে গ্রেনেড হামলা মামলায় বিনা অপরাধে মো. জালাল ওরফে জজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। চার বছর কারাভোগ শেষে ২০০৯ সালের জুনে তিনি মুক্তি পান। বেরিয়ে আসে আসল কাহিনী।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলা নতুন করে তদন্ত শুরু করলে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। ২০০৮ সালে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টায় ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে গ্রেনেড হামলা মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। এরপর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে মামলার রায় দেয় বিচারিক আদালত।

গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় বিচারিক আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিমসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং অপর ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড করা হয়।

শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে জহুর হোসেন চৌধুরী  মিলনায়তনে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু বলেন, উত্তরাধিকারসুত্রে খুনের রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করছে বিএনপি ও খালেদা জিয়া। ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন  ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে জিয়াউর রহমান  আর ২১ আগস্টের গ্রেনেড  হামলাকারীদের মদদ দিয়েছেন খালেদা  জিয়া।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি:

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বার্ষিকীতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে নির্মিত বেদীতে শহীদদের স্মৃতির প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। সকাল সোয়া দশটা থেকে গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদ ও নিহতদের স্মরণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

 

Link copied!