রানা শেখ ওরফে আমির হোসাইন শিখেছিলেন মার্শাল আর্ট, পেয়েছেন ‘ব্ল্যাক বেল্ট’। এক সময় রানা জড়িয়ে পড়েন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে। কুকি-চীন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি, সেই সঙ্গে কুকি-চীনের রিক্রুটার হিসেবেও কাজ করতেন।
রানা শেখসহ জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দার শারক্বিয়ার আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ (লালবাগ)।
মঙ্গলবার (১৪ মে) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিষয়টি জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি স্মার্টফোন ও দুটি বাটনফোন জব্দ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, “মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া রানা ২০০২ সালে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা (হুজি) ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আব্দুর রউফের কাছে প্রশিক্ষণের জন্য ময়মনসিংহে যায়। ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করার পাশাপাশি হুজি সদস্য সামরিক ও আন আর্মড কমব্যাট প্রশিক্ষণ নেয়।”
তিনি আরও জানান, ২০০৩ সালে রানার বাবা, মামা, ভগ্নিপতিসহ মোট ১৮ জন হুজি নেতা আব্দুর রউফের সঙ্গে বৈঠকের সময় ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। এখন আলফা ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ইউনিট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত রানা। এই চাকরির আড়ালে জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নিয়োগকর্তা হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। এর মধ্যেই তিনজনকে সংগঠনের সদস্য বানিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ডেরায় পাঠিয়ে দেন তিনি। প্রশিক্ষণের খরচ বাবদ কেএনএফকে লক্ষাধিক টাকাও দেন এই রানা।
রানার সঙ্গে গ্রেপ্তার বাকি দুই জঙ্গি সদস্যের মধ্যে মশিউর রহমান ইসলামি আন্দোলনের অঙ্গসংগঠন ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন- এই তথ্য জানিয়ে ডিবি প্রধান হারুন বলেন, “২০০২-২০০৩ সালে হুজির সদস্য হিসেবে ময়মনসিংহে আব্দুর রউফের মাদ্রাসায় সামরিক ও আন আর্মড কমব্যাট প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ২০১৩ সালে অন্যান্য হুজি নেতাদের সঙ্গে গ্রেনেডসহ ঝালকাঠিতে গ্রেপ্তার হয়ে সাড়ে চার বছর কারাগারে ছিলেন। পাহাড়ি বৈরী পরিবেশে কমান্ডো হিসেবে টিকে থাকাসহ কয়েকটি বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ২০২১ সালে বান্দরবান চলে যান মশিউর। সেখানে দুই বছর কেএনএফ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে অবস্থান করে প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করতে সমতলে ফিরে আসেন তিনি।”
ডিবি প্রধান জানান, হাবিবুর রহমান জঙ্গি সংগঠন শারক্বীয়ার নতুন সদস্য। তিনি আলফা ইসলামিক লাইফ ইন্সুরেন্সে রানার সহকর্মী ছিলেন। তাকে জঙ্গি মতবাদে দীক্ষিত করে প্রশিক্ষণের জন্য কেএনএফের ডেরায় পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রানা।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজি, আনসার আল ইসলাম ও জামায়াতুল মুজাহিদিনের (জেএমবি) মুক্তিপ্রাপ্ত ও পলাতক বেশ কিছু সদস্য মিলে নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠীতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া গঠন করে- এই তথ্য জানিয়ে ডিবিপ্রধান হারুন বলেন, এই জঙ্গি সংগঠনের নেতা ও সদস্যরা বিশ্বাস করে- ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ নামক এক ধর্মযুদ্ধ হবে। এই ধর্মযুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করবে। বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহীদ অথবা গাজীদের মতো মর্যাদা পাবে বলে বিশ্বাস তাদের।
ডিবি জানায়, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের ধারাবাহিক তৎপরতায় সফল জঙ্গি অভিযানের কারণে জঙ্গি সংগঠনটি সমতল এড়িয়ে পার্বত্য অঞ্চলকে প্রশিক্ষণের জন্য বেছে নেয়। একপর্যায়ে পাহাড়ের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কেএনএফের সঙ্গে যোগাযোগ হয় শারক্বীয়ার। অর্থের বিনিময়ে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা শারক্বীয়ার সদস্যদের বৈরী পরিবেশে টিকে থাকাসহ কয়েকটি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়। দেশকে অস্থিতিশীল করে জঙ্গিদের খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা, নিজ দেশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে জড়িয়ে শহীদ বা গাজী হওয়ার অপেক্ষায় থেকে রসদ সামগ্রী ও কর্মী সংগ্রহে তৎপর ছিল সংগঠনটি।
পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অভিযানে শারক্বীয়ার অনেক সদস্যকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে ডিবি প্রধান হারুন বলেন, “সংগঠনটিতে ৫৩ জনের মতো সদস্য ছিল। ৪৯ জনই এরই মধ্যে ধরা পড়েছে।”
রানা সারা দেশ থেকে সদস্য সংগ্রহের পরিকল্পনায় ছিলেন জানিয়ে হারুন আরও বলেন, “আমরা তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে না পারলে হয়তো আরেকটা গ্রুপকে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হতো। গ্রেপ্তার তিনজনকে চারদিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হবে। তাদের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।”