১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের বর্বর-নির্মম আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণ শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আক্রমণই ছিল না। তারা পুরো জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকলাঙ্গ করার পাঁয়তারা চালিয়েছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সভ্যতাকে পঙ্গু করার চক্রান্ত হয়েছিল। “বাঙালিদের লেখাপড়া শেখার দরকার নেই।”- এটি ছিল ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্রের নরপশু বাহিনীর স্লোগান। তারা বাঙালিদের এমন অবস্থা করতে চেয়েছিল যাতে ভবিষ্যতে বাঙালিরা প্যারিটি অর্থাৎ আর্থিক-রাজনৈতিক সমতার কথা আর বলবে না বরং চ্যারিটি চাইবে। তাদের কাছে দু’হাত পেতে দু’মুঠো খাবার ভিক্ষা চাইবে।
বাংলাদেশে ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্রের ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা পরিচালনার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত, ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাবার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে সম্পূর্ণ পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে ২৫ মার্চ থেকে ন’মাস তাণ্ডবলীলা চালাবার সাথে সাথে বাংলাদেশের সর্বত্র বিভিন্ন গ্রন্থাগারের বই নিয়ে বহ্নি-উৎসব শুরু করেছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাত্রিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাক হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পর বিভিন্ন সময়ে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের সেই বাড়িটিতে চালানো হয় লুটপাট। বইয়ের প্রতি, লাইব্রেরির প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল সুউচ্চ। রাজনীতির সাথে সাহিত্যের প্রেম না হলে জনসাধারণের ভালবাসার উপলব্ধি হয় না।
সাহিত্যের প্রতি অপার অনুরাগ থেকেই কবি জসিমউদ্দীনের সাথে ছিল ভীষণ সখ্যতা, কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। কবিগুরু বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মর্যাদা সমুন্নত করে কড়া জবাব দিয়েছেন উগ্র-সাম্প্রদায়িকতাকে। আমার সোনার বাংলাকে করেছেন জাতীয় সঙ্গীত। শুধু সাহিত্যই নয়, দেশি-বিদেশি সকল আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বইয়ের একজন একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন জাতির পিতা। জীবনের বৃহৎ অংশ কাটিয়েছেন জেলে। জেল জীবনের মুহুর্তগুলো কাটিয়েছেন বই পড়ে।
“শেখ মুজিব আমার পিতা” গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশিরভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন, কিন্তু আমার মা’র অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না। সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলী, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নার্ড শ’র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেয়া ছিল।’ মুক্তাবস্থায় বাসায় থাকাকালীন ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে বই পড়তেন। বই পড়ে শোনাতেন প্রিয় জীবনসঙ্গী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। বইয়ের প্রতি কতটা ভালবাসা, আর কতটা ভাল পাঠক হলে বার্টান্ড রাসেলের বই পড়ে নিজের ছেলের নাম রাখেন শেখ রাসেল! জ্ঞান চর্চা করা ও জ্ঞান সৃষ্টি করার প্রধানতম উপযুক্ত বিষয়টি হল বই পড়া। বই পড়ার ফলে মানব শরীরে দুটি চক্ষের পরিবর্তে চতুর্মুখী চক্ষের সৃষ্টি হয়। দেখতে পায় অতীত-আগামীকে। আর একজন ভাল পাঠক অর্থই একজন দার্শনিক।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের দ্বারা ধানমন্ডি-৩২ এর বাড়িটি আক্রমণের শিকার হয় এবং সপরিবারে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর ঘাতকরা বাড়িটিতে পুনরায় লুটপাট চালায় এবং দীর্ঘসময় বাড়িটি সিলগালা করে রাখে। এসময়ও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলে, অনুমতি সাপেক্ষে বাড়িটিতে প্রবেশ করেন।
বাড়িটিতে প্রবেশের পর চারদিক থেকে ডুকরে কাঁদার গুঙানো শব্দ যেন সমস্ত হৃদয়কে চুরমার করে দিচ্ছিল। গ্রন্থাগারটির দরজা খুলতেই নিঃশব্দে থাকা হাজার হাজার শব্দগুলি সশব্দে চিৎকার করে নির্মমতার কথা জানান দিল। এলোমেলো ও বিচ্ছিন্নভাবে ছিটিয়ে থাকা বইগুলোর করা প্রতিটি প্রশ্ন নিরুত্তর থেকেছিল সেইদিন। গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত কোরআন, বাইবেল-গীতাসহ সমস্ত ধর্মীয় গ্রন্থগুলি অশ্রুজলে প্রার্থনায় সৃষ্টিকর্তার নিকট ফরিয়াদ হাঁকিতেছিল। বইয়ের শেলফগুলো বুলেটের আঘাতে বিচূর্ণ হয়ে প্রতিটা হত্যাকারী প্রতিচ্ছবি তুলে ধরছিল। একটি গ্রন্থাগারে নারকীয় তাণ্ডব দেখে সহজেই অনুমান করা যায় সেদিনে বীভৎসতা নিয়ে। প্রশ্ন তোলা যায় তাণ্ডবকারীদের শিষ্টাচার ও শিক্ষা নিয়ে।
বঙ্গবন্ধু লাইব্রেরির যে চেয়ারে বসতেন তার ঠিক পেছনের শেলভটি বন্দুকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। শেলভে লাগানো কাঁচের গ্লাসগুলো পরবর্তীতে কষটেপ দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে। টেবিলের পাশের শেলভটির গ্লাস দুটির মধ্যে একটিতে গুলি লেগে ছিদ্র হয়ে বেরিয়ে গেছে। চৌচির গ্লাসটি সাক্ষ্য দিতে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। অপর গ্লাসটি খুলে পড়ে গিয়েছিল হয়ত, আবার কেউ হয়ত মমতা করে কষটেপ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। অথচ এই লাইব্রেরি কক্ষটিতে বসেই ২৫ মার্চে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা লিখেছিলেন।
১৫ আগস্টে হত্যাকাণ্ড পরিচালনাকারী ও লুণ্ঠনকারীদের হিংস্রতা নারকীয়তাকেও হার মানিয়েছিল। তাদের ছোড়া বুলেট বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সকলের বুক ঝাঁঝড়া করেছিল। ঝাঁঝড়া করে দিয়েছিল গ্রন্থাগারের সংরক্ষিত বইগুলিকেও। খান ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হুমায়ুন আহমেদের “তোমাদের জন্য ভালবাসা” গ্রন্থটির বুকের ভেতর বুলেট আজও ভালবাসার রক্ত বাঙালির হৃদয়কে স্পর্শ করছে। মমতাজ মতিন নীরা-এর “শ্রদ্ধাঞ্জলী কাজী নজরুল ইসলাম” গ্রন্থটিতে কবি নজরুলের বুকে আঘাত করে যেন অসাম্প্রদায়িক এই বাংলাকেই হত্যা করেছে।
শ্রী ভুপেশ সেন গুপ্তের শিশু উপন্যাস “উড়োজাহাজে কয়েদী” গ্রন্থটির গায়ের বুলেটটি শিশুদের কচি হৃদয়ের লালিত বাসনাকেই হত্যা করেছে। এছাড়াও সেদিনের ছোড়া বুলেট এখনও বইয়ে বেড়াচ্ছে জাদব চক্রবর্তীর “এরিথম্যাটিক ফর দ্য স্কুল অ্যান্ড কলেজ”, ডন মরগানের “ডিরেক্ট ফ্রম ইংল্যান্ড: দ্য গ্রেট নিউ গাইড টু প্লেয়িং গিটার”, অধ্যাপক এল. মুখার্জির “হিস্টরি অব ইন্ডিয়া” এবং ভ্লাদিমির ইলিচ লেলিনের “কালেকটেড ওয়ার্ক, ভলিয়ম-৪৫” গ্রন্থগুলি।
ঢাকার ধানমন্ডি-৩২ এ অবস্থিত ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে’ প্রবেশ করলে মূল ভবনের প্রথম কক্ষটিই বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারটিতে চোখ ফেললেই ভেসে আসবে সেই নারকীয়তা, ভেসে আসবে গ্রন্থগুলির বুকে লেগে থাকা বুলেট। সেখানে গ্রন্থপ্রেমী কোনো বাঙালি চোখের জল লুকাতে পারে না। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদ্যানন্দিনী শেখ হাসিনা গ্রন্থাগারের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করে ২০১৭ সালে ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। সরকার ঘোষিত আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক গড়তে দেশের গ্রন্থাগারসমূহ কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করছি।
লেখক: এম. রাশিদুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-গ্রন্থাগারিক হিসেবে কর্মরত।