গুড কতটা ‘গুড’?

আদিত্য নন্দী

আগস্ট ৪, ২০২৩, ০৯:১৩ পিএম

গুড কতটা ‘গুড’?

বব গুড যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া থেকে নির্বাচিত একজন রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য। করোনা মহামারির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে অনুষ্ঠিত একটি সমাবেশে তিনি যোগ দেন। সেখানে ট্রাম্প সমর্থকেরা বাইডেন ও তার দল কর্তৃক নির্বাচনের ফলাফল বিকৃত করার বিরুদ্ধে করা মামলা সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। সমাবেশ চলাকালীন ‘গুড’ এই তত্ত্বটি প্রচার করেছিলেন যে, ‘ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচন চুরি করার জন্য একটি গভীর ষড়যন্ত্র করেছে’। তিনি আরো বলেছিলেন যে, করোনা ভাইরাসটি বাস্তব হলেও মহামারিটি ভুয়া। 

৬ জানুয়ারি, ২০২১ গুড যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রত্যায়িত করার বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেন। ১৭ জানুয়ারি, ২০২১ তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্যাপিটল হলে’ সৃষ্ট সহিংসতায় ক্যাপিটল এবং কংগ্রেসের সদস্যদের সুরক্ষায় ‘ক্যাপিটল পুলিশ’ এবং ‘ডিস্ট্রিক্ট অফ কলম্বিয়া মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্ট’-এর সদস্যদের ভূমিকার জন্য কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল প্রদানকারী একটি হাউস বিলের বিরুদ্ধে ভোট দেন। 

বব গুড প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অভিশংসনের প্রচেষ্টার সমর্থক ছিলেন। ১১৭ তম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের সময়, বব গুড প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অভিশংসনের জন্য তিনটি প্রস্তাবে কো-স্পন্সর ছিলেন। তিনি মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে অভিশংসনের জন্যও কো-স্পন্সর করেছিলেন। 

শুধু তাই নয়, ১১৮তম কংগ্রেসের সময় বব গুড হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারিকেও অভিশংসনের জন্য আরেকটি রেজোলিউশনে সহায়তা করেছিলেন। এতক্ষণ ধরে মার্কিন কংগ্রেসম্যান বব গুডের বিভিন্ন কার্যক্রমের যেসকল তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, তার অধিকাংশই ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের অব্যবহিত পরে। বিশেষ করে বলতে গেলে মার্কিন রিপাবলিকান দলের কট্টরপন্থি নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম, যিনি ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ মনে করেন, এবং ষড়যন্ত্রের ফলেই নির্বাচনের ফলাফলে কারচুপির মাধ্যমে ট্রাম্প-কে নির্বাচনে পরাজিত করা হয়েছে মনে করেন। 

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে মার্কিন একজন কংগ্রেসম্যানের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে লেখার কারণ হলো, সাম্প্রতিক সময়ে তিনি সহ আরো কয়েকজন কংগ্রেসম্যানের বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি এবং বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চিঠির মাধ্যমে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বহিঃপ্রকাশ এবং জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল দপ্তর থেকে সেসব বিষয়ে অবগত হওয়ার বক্তব্য প্রকাশ এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং কতিপয় মিডিয়া কর্র্তৃক সেসব চিঠির বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া।

গতকাল একটি সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারলাম, বব গুড একটি টুইটের মাধ্যমে জানিয়েছেন যে, ‘অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের প্রাপ্য। তিনিসহ তার আরও ১৩ জন সহকর্মী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর সহিংসতা চালানো হচ্ছে মর্মে চিঠি জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বরাবর দেয়া হয়েছে বলে তিনি ওই টুইটে উল্লেখ করেছেন’। একটি উন্নত রাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান যেকোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে উদ্বেগ জানালে, কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনলেই তা সঠিক হয়ে যায় কিনা এবং তা তার সম্পর্কে কোন তথ্যানুসন্ধান না করেই, কিংবা প্রকৃত উদ্দেশ্য যাচাই না করেই গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ ও কোড করা উচিৎ কিনা? শুধু বব গুড নয়, ৬ জন কংগ্রেসম্যানের মধ্যে স্কট পেরি ও আরো অনেকের রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা ‘গণতন্ত্রের বাতিঘর’ যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের প্রশ্ন তুলেছেন, যা পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। 

আরো গভীরভাবে বললে, তারা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্টকে স্বীকৃতি দেন নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা জো বাইডেন প্রশাসনকেই এখনো স্বীকৃতি দেয়নি, যারা ‘ক্যাপিটল হলে’ সহিংসতা রক্ষায় প্রধান ভূমিকা পালনকারী ‘ক্যাপিটল পুলিশ’ এবং ‘ডিস্ট্রিক্ট অফ কলম্বিয়া মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্ট’-এর সদস্যদের ভূমিকার জন্য কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল প্রদানকারী একটি হাউস বিলের বিরুদ্ধে ভোট দেয়, যারা ফলাফল কারচুপির অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্টের অভিশংসনের প্রস্তাব আনে, যারা ২০২০ সালে প্রশাসন কর্তৃক ‘নির্বাচনী ফলাফল কারচুপি’ ধামাচাপা দেয়ার জন্য ‘ক্যাপিটল হলে’ আন্দোলনরত ট্রাম্প সমর্থকদের উপর পুলিশি সহিংশতার অভিযোগ আনে, যারা ‘গণতন্ত্রের বাতিঘর’ হিসেবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবনা কি। তাদের চিঠি আমলে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য কোন বৈশি^ক সংস্থা যখন বক্তব্য দেয়, তখন এইসব কংগ্রেসম্যানদের অতীত কার্যক্রম কিংবা রাজনৈতিক দাবিকে তারা স্বীকৃতি দেয় কিনা?

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল এবং ‘ক্যাপিটল হলে’ পুলিশি সহিংসতা নিয়ে  ‘বব গুড’ কিংবা আরো কতিপয় কংগ্রেসম্যানের বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করা হলে, কংগ্রেসম্যানদের বাংলাদেশের নির্বাচন ও বিরোধী দল-মতের উপর নির্যাতনের দাবিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বলে প্রতীয়মান হয় কিংবা এরূপ প্রশ্ন তোলে। আর বাংলাদেশ নিয়ে তাদের দাবি উদ্দেশ্যহীন এবং স্বার্থহীন দাবি করা হলে, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ নির্বাচন এবং পুলিশি ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যায়।

পশ্চিমা দেশসমূহ এবং জাতিসংঘের কাছে প্রশ্ন থাকবে, নির্বাচনকালীন নয় শুধু, যেকোন পরিস্থিতিতে সহিংসতা নিরশনে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ‘ক্যাপিটল হলে’ যে ভূমিকা রেখেছে, তা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বেআইনি কিংবা অনৈতিক কিনা? যদি আইনানুগ হয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশেও অনুরূপ সহিংসতা নিরশনে পুলিশি ভূমিকা নিয়ে কেন ভিন্নমত? 

পরিশেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কংগ্রেসম্যান বব গুড নামের ব্যাক্তির বেড উদ্দেশ্যের চিঠিতে রেজিম চেইঞ্জের ষড়যন্ত্রের অংশ না হয়ে নিজের দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানাই বিরোধী রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সংবাদমাধ্যম তথা সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা।

Link copied!