ছয় দফা : বাঙালির মুক্তির সনদে যেভাবে এসেছিল বাধা

গোলাম রাব্বানী

জুন ৭, ২০২৩, ১১:৩৬ পিএম

ছয় দফা : বাঙালির মুক্তির সনদে যেভাবে এসেছিল বাধা

নিজেদের অধিকার আদায়ের আদায়ের সংগ্রাম বাঙালি জাতি অনেক আগে থেকেই করে আসছে। কিন্তু নিজেদের আত্মপরিচয়ের চাহিদা, এর জন্য সংগ্রামের প্রেরণা, নিজেদের স্বপ্নের বাস্তবিক কাঠামো বাঙালি জাতি ছয় দফা থেকেই পেয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালের ছয় দফা অন্যতম মাইলফলক।

তবে ছয় দফা দাবিগুলো বিষয় যদি দেখেন তাহলে দেখবেন তিনটি দফাই ছিল অর্থনীতি ও ব্যবসা সংক্রান্ত। তবে ঠিক কি কারনে এই ছয় দফা রাজনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্থির থেকে, অর্থনৈতিক দিকটি সামনে নিয়ে আসা একটি কৌশল ছিল মাত্র। অবশ্যই বুঝতে হবে যে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম তখনও পরিচালিত হচ্ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে। এবং বঙ্গবন্ধু ভাল করেই জানতেন, তার যে কোন একটি ভুল পদক্ষেপ পূর্ব বাংলার জনগণের বৈধ এবং ন্যায়সংগত আন্দোলনকে শাসকশ্রেণি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করবে।

ঠিক সেটাই ঘটলো। ছয় দফার অর্থনৈতিক দিকের প্রতি গুরুত্ব এবং তার  বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো ছয় দফায় পূর্ব -পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝের বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, শুধুই রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবাদীর গন্ধ পায়। যেমন, তদানিন্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মন্তব্য করেন যে, ছয় দফা ফর্মুলা একটি ‍‍`successionist move‍‍` যা তিনি প্রয়োজনে শক্ত হাতে প্রতিহত করবেন বলে শাসান। ১৯৬৬ সনের মার্চে, ঢাকায় নিজ রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ (কনভেনশন)‍‍`এর এক সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন– "if necessary the government of Pakistan would use the ‍‍`Language of Weapon‍‍` against those elements who would talk of the Six Point Programme" (Moudud Ahmed, Bangladesh: Constitutional Quest for Autonomy 1950-1971, p.87)।

আইয়ুব খানের মত জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানও মনে করেন – "Six Point Programme is nothing, but an unjust plan to divide the country" (Hasan Zaheer, The Separation of East Pakistan: The Rise and Realization of Bengali Muslim Nationalism, 1994,  p.127)। তখন জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিউপিলস্‌ পার্টি অব পাকিস্তান (পিপিপি) পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল।  ভুট্টো আগাগোড়াই ভাবতেন যে ছয় দফা ভারতের কারসাজি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রকাশিত তার লেখা গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেন – "… the well and long planned conspiracy with India that came to light after 25th

" (Zulfikar Ali Bhuto, The Great Tragedy, 1971, p. 57)। নির্বাচনের পর ১৯৭১-এ আলোচনার সময়ও ভুট্টো বিশ্বাস করতেন যে- "the Awami League was moving in fact toward independence" (Salauddin Ahmed, Bangladesh – Past and Present, 2004, p.160)। এ বিষয়ে সালাউদ্দিন আহাম্মেদ তার এই গ্রন্থে একটি উল্লেখযোগ্য দিকের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি জানান – "in order to diffuse the appeal of the Six Point Programme, Bhutto wanted to influence Maulana Bhashani behind Mujib‍‍`s back. He impressed upon the Maulana that the Six Point Programme had the backing of the American authorities in order to reduce the growing friendship between Pakistan and China"।

উল্লেখ্য যে, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তখন পিকিং-পন্থি (আজগের বেজিং-পন্থি) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি। ভুট্টোর কথায় মওলানা ভাসানী কতটুকু প্রভাবিত হয়েছিলেন তা আমাদের অজানা, তবে বঙ্গবন্ধু ২ জুন ১৯৬৬ সনে কারাগারে বসে লিখেন– "মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে" (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ ৫৭)। রংপুরের মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়া তখন মওলানা ভাসানীর ডেপুটি। ছয় দফার উপর মন্তব্য করে তিনি বলেন – "ছয় দফা কর্মসূচী কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে" (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ ৫৭)। সেই সাথে আরও যোগ করেন যে, তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তা হলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না। যাদু মিয়ার এ বিবৃতি ফলাও করে  প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সনের ২ জুনে ‍‍`মর্নিং নিউজ‍‍` পত্রিকায়। দুঃখের বিষয়, যে ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মাঝে ধাপে ধাপে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছা্য়, সেই  কর্মসূচি সম্পর্কে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের তথাকথিত প্রগতিবাদী কিছু দলের মনোভাব ও রাজনৈতিক অবস্থান আর পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শ্রেণির মনোভাবের তেমন কোন তফাৎ ছিল না।

ভাসানী ন্যাপ ছাড়াও ছয় দফা পরিকল্পনার প্রতি অন্যান্য দলের মনোভাবও একই রকম ছিল। যেমন, জামায়াতে ইসলাম ছয় দফাকে ‍‍`বিচ্ছিন্নতাবাদীতার নকশা‍‍` হিসাবে চিহ্নিত করে; নিজাম-ই-ইসলাম এই পরিকল্পনাকে মুজিবের পক্ষে ‍‍`একতরফা, একনায়কতান্ত্রিক‍‍` পদক্ষেপ হিসাবে বাতিল করে এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগ ছয় দফা দাবিকে ফেডারেশন নয়, ‍‍`কনফেডারেশনের‍‍` দাবি হিসেবে বর্ণনা করে (Raunak Jahan: Pakistan: Failure in National Integration, 1994, pp. 139-140)।

পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনেতিক, সেই সাথে কিছু সংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি বিরোধী প্রতিক্রিয়া বা বৈরি মনভাব শুধুই ছয় দফার বলিষ্ঠতাই প্রমাণ করে । বলাবাহুল্য, ঐতিহাসিক ছয় দফা একটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট দাবিমালা, যার মাঝে অন্তর্নিহিত ছিল পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, যা ছিল বাঙালি জাতির আত্ননিয়ন্ত্রণের পথে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

Link copied!