পায়রা সমুদ্রবন্দর: সমৃদ্ধির পথে আরও এক ধাপ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ১, ২০২২, ০৮:২৮ পিএম

পায়রা সমুদ্রবন্দর: সমৃদ্ধির পথে আরও এক ধাপ

দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানির চাহিদা মেটাতে নির্মিত হচ্ছে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব পায়রা সমুদ্রবন্দর। উন্নয়নের মহাসড়কে যোগ হতে যাচ্ছে অমিত সম্ভাবনাময় এক সমুদ্র বন্দর। মেরিটাইম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপমহাদেশে সবার আগে দেশের জন্য নিজস্ব সমুদ্র এলাকা দাবি করেন। তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে মেরিটাইম বাংলাদেশের প্রকৃত যাত্রা শুরু হয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলাস্থ আন্ধারমানিক নদীর উপকণ্ঠ ধরে রাবনাবাদ চ্যানেলের তীর বরাবর গড়ে ওঠা দেশের তৃতীয় এই সমুদ্রবন্দরটি মূলত লালুয়া, বালিয়াতলী, ধূলাসার, ধানখালী ও টিয়াখালী মৌজাব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভিত্তিফলক উন্মোচনের মাধ্যমে বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।

সেই ধারায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত হলে ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট সমুদ্রবন্দরটি প্রথমবারের মতো কন্টেইনার জাহাজ নোঙরের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে কন্টেইনার টার্মিনাল, বাল্ক টার্মিনাল, মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, মডার্ন সিটি, বিমানবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলাসহ ১৯টি কম্পোনেন্টের কাজ চলমান রয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে পায়রা বন্দরকে বিশ্বমানের একটি আধুনিক বন্দর এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে অর্থনীতির সহায়ক শক্তি হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এসব উন্নয়ন কার্যক্রম দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।

মূলত উদ্বোধনের পর থেকেই সীমিত পরিসরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমসহ বন্দরে বহিঃনোঙ্গরে অপারেশনাল কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ফলশ্রুতিতে ১৬৯টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের অপারেশনাল কার্যক্রম সম্পন্ন করে ৩৫৪ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। বন্দরের মূল চ্যানেলে ক্যাপিটাল ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের জন্য বেলজিয়াম ভিত্তিক ড্রেজিং কোম্পানি ‘জান ডি নুল’-এর সঙ্গে সমঝোতা স্মারকপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি দেশের রিজার্ভের অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের’ প্রথম প্রকল্প চুক্তি। এ চুক্তির ফলে ৫৩ ভাগ অর্থ সাশ্রয় হবে, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও উজ্জ্বল করবে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার রাবনাবাদ চ্যানেলের পোতাশ্রয় মুখ থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে শিপিং-বান্ধব বিস্তীর্ণ এলাকাটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য প্রকৃতি এবং ভৌগোলিকতার নিরিখে উপযুক্ত একটি অঞ্চল। তা ছাড়া বন্দর উন্নয়ন ও পরবর্তী সম্প্রসারণের জন্য এখানে প্রচুর পরিত্যক্ত জমি আছে। পাশাপাশি সার্বজনীন ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্যও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ উন্মুক্ত স্থান।

ফলে কন্টেইনার, বাল্ক, সাধারণ কার্গো, এলএনজি, পেট্রোলিয়াম ও যাত্রী টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অঞ্চল, তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা, ঔষধশিল্প, সিমেন্ট, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, সার কারখানা, তৈল শোধনাগার ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ আরও নানাবিধ কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা সম্ভব হবে। বর্তমানে চাহিদার মাত্র ৩০ শতাংশ সার দেশে উৎপাদন হয়। বাকি ৭০ ভাগ সার বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ হলে গ্যাসের মাধ্যমে সার কারখানা চালু করা সম্ভব হবে। ফলে সারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। পায়রা বন্দর নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পায়রা বন্দর নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রায় ৩,৪২৩টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। ৪৮৪ একর ভূমিতে ১৪টি প্যাকেজে মোট সাতটি কেন্দ্রে ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য বাড়িগুলো নির্মিত হয়েছে। বাড়িগুলোর মধ্যে এ-টাইপের বাড়ি ১,১৬৫টি এবং বি-টাইপের বাড়ি ২,২৫৮টি। এ-টাইপের বাড়িগুলো চার কাঠা জায়গার উপর ৯৭৮ বর্গফুটের এবং বি-টাইপের বাড়িগুলো তিন কাঠা জায়গার উপর ৮৮৫ বর্গফুটের বিল্ডিং। প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে তিনটি বেডরুম, দুটি বাথরুম, একটি কিচেন এবং একটি বারান্দা; যার মধ্যে এটাচড বাথরুমসহ একটি মাস্টার বেডরুম আছে।

প্রতি চারটি বাড়ির জন্য একটি সেপটিক ট্যাংক (৫০ জন ব্যবহারকারীর ধারণক্ষমতা সম্পন্ন) রয়েছে এবং প্রতিটি বাড়িতে ওভারহেড ওয়াটার ট্যাংকের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া রাস্তা, স্কুল, মসজিদ, বিদ্যুৎ, মার্কেট, পুকুর, খেলার মাঠ, পরিবেশবান্ধব সামাজিক বনায়ন ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুবিধাদি রয়েছে। পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল ও এর সংযোগ সড়ক এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক পরিবারকে বাড়ির চাবি হস্তান্তর করেছেন।

ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের পুনর্বাসিত করার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ওই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় ৪,২০০ জনকে ২২টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৬টি ট্রেডে ১০৪টি ব্যাচে মোট ২৬০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। যারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে ১,৯৭৫ জন বিভিন্ন ট্রেডের উপর আয় বৃদ্ধিমূলক কাজের সঙ্গে ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে ১২টি ট্রেডের উপর ৩৪টি ব্যাচে আরও ৮৫০ জনের প্রশিক্ষণ প্রদান করার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি ব্যাচে ৩৫০ জনের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। ট্রেডগুলো হলো-বেসিক কম্পিউটার, ওয়েলডিং, মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ/ লেদমেশিন, মোবাইল সার্ভিসিং ও রিপেয়ারিং উল্লেখযোগ্য। ওই প্রশিক্ষণের ফলে ইতোমধ্যে স্থানীয় জনগণের উপার্জন বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে।

পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ইপিজেড, এসইজেড, জাহাজ নির্মাণ এবং মেরামতি খাতে ব্যাপক কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে। নতুন শিল্পাঞ্চল সৃষ্টির সুবাদে বন্দর সংলগ্ন জেলা বরিশাল, পটুয়াখালী এবং ভোলাসহ দেশের অন্যান্য জেলার মানুষের একদিকে যেমন কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে তেমন দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি নিশ্চিত হবে। পোশাক শিল্পের মতোই গতিশীল হচ্ছে জাহাজ নির্মাণ শিল্প। ফলে এখানে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রসার ঘটবে। দেশে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক জাহাজ নির্মাণ কারখানা রয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে জাহাজ শিল্পে প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলারের বাজারে বাংলাদেশের দখল মাত্র ৪শ কোটি ডলার। পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে এ শিল্পখাত বিকশিত হলে অচিরেই বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা রফতানিকারক দেশ হবে বলে আশা রাখি।

২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই আমরা। অতএব বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এ লক্ষ্যেই উপকূলীয় এলাকায় ৫/৬টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎ স্থাপনা গড়ে তুলছে সরকার। পায়রা বন্দরে একটি ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়েছে। কয়লা আনলোড করার জন্য একটি কয়লা টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে পায়রা বন্দরে। এসব কার্যক্রমের ফলেও বিপুল রাজস্ব আয়ের সুযোগ তৈরি হবে এখানে।

সড়ক পথের তুলনায় নৌপথে যাতায়াত ও মালামাল সরবরাহ অধিকতর সহজ ও সাশ্রয়ী বিধায় বরিশাল হয়ে খুলনা এবং মাদারিপুর অঞ্চলে সিমেন্টের ক্লিংকার এবং খাদ্যশস্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে এই পায়রা বন্দর।

বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত এবং চীনের সমন্বিত উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে গড়ে উঠছে ইকোনমিক করিডোর। সমুদ্রের সন্নিকটে নির্মিত বন্দর বলে প্রতিবেশী দেশগুলো ট্রানজিট সুবিধা গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এ ছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধার কারণে সমুদ্রপথে সিল্করুটের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে পায়রা বন্দর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হয়ে ওঠারও সম্ভাবনা রয়েছে।

২০১৪ সালে ১৯টি দেশের ৩২ জন বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি নিয়ে ঢাকায় ব্লু-ইকোনমির উপর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গোপসাগরকে আমাদের তৃতীয় প্রতিবেশী হিসাবে অভিহিত করে বলেন, সমুদ্রপথে ব্যবসার পরিধি বিস্তার, সাগরের খনিজ সম্পদ কাজে লাগিয়ে জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন, সামুদ্রিক মাছের যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং সমুদ্র পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার মাধ্যমেই সুনিশ্চিত হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রগতি। সমুদ্র সম্পদে রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

ফিসিং, রিনিউয়েবল এনার্জি, সমুদ্র শৈবাল, মূল্যবান খনিজ, জিরকন, মিনারেল, শিপিং, মেরিন ইন্ডাস্ট্রি এবং টুরিজমসহ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সম্পদের আধার এই সমুদ্র। কাজেই আমাদেরকে এখন ব্লু-ইকোনমির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ব্লু-ইকোনমির মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদের কার্যকর ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সমুদ্র-সম্পদের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে একদিকে যেমন খাদ্য উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে, বিপর্যয় এবং দুর্যোগ প্রতিরোধ হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় বঙ্গোপসাগরে প্রায় এক লাখ বিশ হাজার বর্গকিলোমিটার জলসীমার ওপর আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রতলদেশে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার এলাকার জৈব-অজৈব সব সম্পদের মালিকানা এখন আমাদের। প্রায় ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাসের মজুদ রয়েছে এখানে। পায়রা বন্দর প্রতিষ্ঠা হলে ব্লু-ইকোনমি অর্থাৎ সুনীল অর্থনীতির গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র সম্পদ আহরণ, ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটবে। ফলে সমুদ্র সম্পদ তথা সুনীল অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে বিরাট কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

পদ্মা সেতুকে কানেক্ট করে বরিশাল থেকে পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ফলে পায়রা বন্দরের সঙ্গে সুগম হবে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ। অতঃপর রেলপথের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য জেলার সঙ্গে যুক্ত থাকবে পায়রা বন্দর। পায়রা থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানের নৌযান চলাচলে বর্তমানে দুটি রুট রয়েছে।

একটি পটুয়াখালী হয়ে বরিশাল। অন্যটি ভোলার পশ্চিম থেকে শুরু করে কাজল এবং তেঁতুলিয়া নদী হয়ে কালিগঞ্জ। আকাশপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি বিমানবন্দর গড়ে উঠবে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। ফলে পায়রা বন্দর হয়ে উঠবে সব ধরনের অর্থনৈতিক উন্নতির এক কেন্দ্রবিন্দু। বহিঃনোঙ্গরে ক্লিংকার, সার ও অন্যান্য বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজ আনয়ন ও লাইটার জাহাজের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পরিবহণ করার জন্য কাস্টমস কর্তৃক প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি যেমন কাস্টমস শুল্ক স্টেশন হিসাবে ঘোষণা, জনবল নিয়োগ, শিপিং এজেন্ট নিয়োগ, সিএন্ডএফ এজেন্ট নিয়োগ এবং বন্ডেড এরিয়া ঘোষণা ইত্যাদি করা হয়েছে। পায়রা বন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের একটি স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। তা ছাড়া, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি শেরে বাংলা নির্মিত হলে বন্দরের নিরাপত্তা অধিকতর সুরক্ষিত হবে।

বরিশাল বিভাগীয় অঞ্চল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কবলিত এলাকা। পায়রা বন্দর প্রকল্প চালু হলে একে ঘিরে গড়ে উঠবে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। ফলে প্রতিহত হবে ঝড়ের আঘাত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহজ হবে। উপরন্ত এখানে উপকূল জুড়ে গড়ে তোলা হবে সবুজ বেষ্টনী এবং ইকো-ট্যুরিজম। এক বা একাধিক পাঁচতারা হোটেল স্থাপনের মাধ্যমে অত্র এলাকাটিকে সহজেই একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রে উন্নীত করা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কমপ্লেক্স নির্মাণ, জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপন, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ, জেটি/ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ, ইকো পার্ক/ ফরেস্ট গড়ে তোলা, মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ, সি-অ্যাকুরিয়াম নির্মাণ, আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণ, গলফ ও টেনিস কমপ্লেক্স নির্মাণ, কনভেনশন সেন্টার নির্মাণসহ বহু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

২০২৩ সালের মধ্যে ১০ মিটার গভীরতার চ্যানেল ড্রেজিং সম্পন্ন করত পূর্ণাঙ্গ বন্দর সুবিধা নিশ্চিতকল্পে পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের প্রায় ৭৫ কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পায়রা বন্দরে নির্দিষ্ট ড্রাফটের জাহাজ প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট চ্যানেলের গভীরতা বজায় রাখা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে পায়রা বন্দরের ‘রাবনাবাদ চ্যানেলের (ইনার ও আউটার চ্যানেল) জরুরি মেইনটেনেন্স ড্রেজিং’ প্রকল্প বাস্তবায়নের নিমিত্তে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বেলজিয়ামভিত্তিক ড্রেজিং কোম্পানি ‘জান ডে নুল’ এর মধ্যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে ড্রেজিং কার্যক্রম চলমান আছে। ভূমধ্যসাগর ও লোহিতসাগরের সংযোগকারী পৃথিবীর বৃহত্তম কৃত্রিম চ্যানেল সুয়েজখাল খননের একক কৃতিত্বের অধিকারী জান ডে নুল।

এই কোম্পানি ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার বহু বন্দরে বৃহত্তর পরিসরে বিভিন্ন ড্রেজিং প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ড্রেজিং কোম্পানি বেলজিয়ামের ‘জান ডে নুল’র ড্রেজার বহরে রয়েছে সর্বাধুনিক ও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কাটার সাকশন ড্রেজার ও ট্রেইলিং সাকশন হপার ড্রেজার। বর্তমানে এ বন্দরের চ্যানেল গভীরতা ৬.৩ মিটার, যা বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)-এর অর্থায়নকৃত ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।

এ ছাড়াও পায়রা বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় অদূর ভবিষ্যতে চ্যানেলের গভীরতা ১০.৫ মিটারে উন্নীত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার বাস্তবায়ন কিছুটা সময় সাপেক্ষ হওয়ায়, মধ্যবর্তী সময়ের রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে চ্যানেলের বর্তমান গভীরতা ৬.৩ মিটার বজায় রাখাই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। রাবনাবাদ (ইনার ও আউটার) চ্যানেলের প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১০০-১২৫ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট চ্যানেলে আনুমানিক ৯.৭৫ মিলিয়ন ঘনমিটার পলি অপসারণ করে চ্যানেলের ৬.৩ মিটার গভীরতা বজায় রাখা হবে। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৪৩৭.৩০ কোটি টাকা এবং প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুদানে গঠিত পায়রা বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকে সংকুলান করা হবে।

ক্যাপিটাল ও মেইনটেনেন্স ড্রেজিংটি সম্পন্ন হলে চ্যানেলের গভীরতা ১০.৫ মিটার উন্নীত হবে। ফলে সহজেই অধিক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজের চলাচল নিশ্চিত করা যাবে এবং বন্দরকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। ২০২৩ সালের মধ্যে এই ড্রেজিং কাজটি শেষ হলে বন্দরে ৩,০০০ টিইইউ বা ৪০,০০০ ডিডাব্লিউটি কার্গো বহনক্ষমতাসম্পন্ন বড় বাণিজ্যিক জাহাজ ভিড়ানো সম্ভব হবে।

এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বন্দরটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটবে। বন্দরটিকে ঘিরে এ অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে, অবকাঠামো উন্নয়ন হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপুল প্রসার ঘটবে। এর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সার্বিকভাবে বন্দরের কর্মকাণ্ডের সুফল সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

ধারণা করা যায়, এ বন্দর প্রতিষ্ঠার ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে গতি সঞ্চার হবে তাতে দেশের জিডিপি প্রায় ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ফলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গঠনের পথে দেশ এগিয়ে যাবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ গড়ায় এ বন্দর বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: প্রতিমন্ত্রী, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

Link copied!