দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু ও দুই হাজারের অধিক মানুষের আহতাবস্থার সৃষ্টি করেছে সুদানের গৃহযুদ্ধ। অবশ্য দেশটিতে গৃহযুদ্ধ এই প্রথমই নয়। আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ হিসেবে পরিচিত দেশটিকে গৃহযুদ্ধ ভেঙে দু টুকরো করে দিয়েছিল। এখন আবার দেশটির সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই দেশটির পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে দিয়েছে।
সুদানে বেসামরিক সরকার গঠনের অংশ হিসেবে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে (আরএসএফ) সেনাবাহিনীর সাথে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হলে এই দ্বন্দ্বের শুরু হয়।
এই সংঘাত দীর্ঘ সময় ধরে চলবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষকরা। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং সেনা সদরদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘস্থায়ীভাবে অস্থিতিশীল দেশটির রাজধানী খার্তুমে নজিরবিহীন এই লড়াই চলছে।
এদিকে সংঘাতের কেন্দ্রে থাকা শীর্ষ দুই জেনারেল সুদানের শাসক আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান এবং তাঁর ডেপুটি এবং আরএসএফের প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো পরস্পরকে দায়ী করছেন। যদিও এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত বহুকাল আগেই হয়েছিল।
উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৯৮৯ সালে ওমর আল-বশির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই ২০১১ সালে দেশটি বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ সুদানের জন্ম হয়। এর আগ পর্যন্ত সুদান ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ।
আন্তর্জাতিক নিন্দা ও সমালোচনা সত্ত্বেও দেশটির কুখ্যাত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপের অংশ যারা দারফুরের বিদ্রোহীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিল তাদের আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেন ওমর আল-বশির। যার নাম দেওয়া হয় বর্ডার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটস। পরে ২০১৩ সালে গঠিত হয় আরএসএফ বাহিনী, যেটির কার্যক্রম তদারকি করতেন ওমর আল-বশির নিজেই। আর বাহিনীটির প্রধান ছিলেন জেনারেল দাগালো। তিনিই পরবর্তীতে বুরহানের সাথে হাত মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। আল-বশিরকে উৎখাতের পর সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকারে উপ-প্রধানের দায়িত্ব পান তিনি।
দাগালোর হাত ধরে আরএসএফ হয়ে ওঠে আরও শক্তিশালী। ২০১৯ সালে রুটির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। বিক্ষোভ চলাকালে ১২০ জনেরও বেশি প্রতিবাদকারীকে হত্যা করে আরএসএফ বাহিনী। পরে সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন আল-বশির। যেভাবে তাঁর শাসনামল শুরু হয়েছিল সেভাবেই ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাঁকে। যদিও তার এই পতন দেশটিতে শান্তি নিয়ে আসেনি।
পরবর্তীতে বাহিনী ইয়েমেন ও লিবিয়ার সংঘাতেও জড়িয়ে পড়ে আরএসএফ। শুধু তাই নয় সুদানের বেশ কয়েকটি সোনার খনিতেও তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। দেশটির সেনাবাহিনী বিদ্যমান থাকার পরও সময়ের সাথে সাথে আধা-সামরিক হিসেবে এমন শক্তিশালী একটি বাহিনীর উপস্থিতিই সুদানে নিয়ে আসে অস্থিতিশীল অবস্থা।
ওমর আল-বশিরকে উৎখাতের পর দেশটি পরিচালনা করতে দুই বছরের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সামরিক কাউন্সিল গঠন করা হয়। যারা নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পরে বেসামরিক ও সামরিক- এই যৌথ নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হয়।
সে সময় সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হওয়ায় দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান অন্যদিকে কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান হেমেডটি নামে অধিক পরিচিত দেশটির উপ-নেতা জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো। ২০১৯ সালে বশিরের পতন ও ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানেও একসাথে কাজ করেছিলেন তাঁরা।
নানা বিষয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা-ভাগাভাগির সেই সরকারকেও উৎখাত করা হয়। এর মধ্যে ২০২২ সালে ডিসেম্বর মাসে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে এক সমঝোতায় সব পক্ষ সম্মতি জানিয়ে চুক্তিবদ্ধ হতে চেয়েছিল। কিন্তু মতবিরোধের কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়।
সুদানের ভবিষ্যৎ এবং দেশটির বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাবনা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ান এই দুই জেনারেল। মূলত এক লাখ সদস্যের র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা এবং যে নতুন বাহিনী গঠিত হবে তার নেতৃত্ব নিয়েই মতবিরোধ শুরু হয়। শুরু হয় সামরিক কাউন্সিলের দুই নেতা জেনারেল আল-বুরহান এবং জেনারেল দাগালোর মধ্যে বিরোধ। তার জের ধরেই ১৫ এপ্রিল শনিবার শুরু হয় আরএসএফ বাহিনী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে লড়াই।
অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসেবে চলমান এ যুদ্ধ দেশটির অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আরও অবনতি নিয়ে আসছে। দুই লাখেরও বেশি সুদানের সেনাবাহিনীর সৈন্য আর বিপরীতে অনেক বেশি প্রশিক্ষিত এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আরএসএফ বাহিনীর এক লাখ সৈন্য। ধারণা করা হচ্ছে এই লড়াই বন্ধ না হলে দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করবে।
দেশটির সামরিক গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বেসামরিক সরকারের কাছে শাসনভার হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটির ওপর অনিশ্চয়তার চাদর ঢেকে দিলো তার আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
অবশ্য পরিস্থিতি বলছে সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে এই বিরোধ চললেও অনেকেই গণতন্ত্রের চেয়ে দেশের শান্তি ও স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হওয়াটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এদিকে সুদানের গৃহযুদ্ধ হলেও এই যুদ্ধ আন্তর্জাতিক মহলেও প্রভাব ফেলছে। অনেক দেশ নিজেদের স্বার্থেই এই লড়াইয়ে উসকানি দিচ্ছেন আবার অনেকে যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে বার্তা প্রেরণ করছেন। দেশটিতে থাকা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও দুই পক্ষের প্রতি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
উভয় পক্ষের প্রতি আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন পশ্চিমা এবং আঞ্চলিক নেতারা। অন্যদিকে মিশর সরকার চায় সুদানে একজন স্বৈরাচারী শাসক থাকুক তাই বুরহান তাদের সমর্থন পাচ্ছে যদিও এটি অস্বীকার করে মিশর জানায় তারা এই বিরোধে হস্তক্ষেপ করছে না। অন্যদিকে আধা-সামরিক গোষ্ঠীর প্রধান হেমেটির সাথে ইথিওপিয়া, ইরিট্রিয়া, ইয়েমেনের ভালো সম্পর্ক আছে। মস্কোর সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
দুপক্ষকেই সমান তালে সামলে মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকায় আছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন। বুরহান ও হেমেটি দুজনের সাথেই কথা বলে অবিলম্বে সংঘর্ষ বিরতির কথা বলেছেন ব্লিংকেন।
বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুদানে কর্মরত জাতিসংঘের মিশনের প্রধান ভলকার পার্থেস বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি খুবই অস্পষ্ট। তাই লড়াইয়ের ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য কোথায় স্থানান্তরিত হচ্ছে তা বলা খুব কঠিন।’
সোনার খনির দেশ সুদানে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই গৃহযুদ্ধের শেষে আরও একটি ভাগ চলে আসবে কি না সেটি নিয়েও ভাবনার উদ্রেক হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক