সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৩, ০৮:৩৯ পিএম
সদা হাস্যোজ্জ্বল এক দীপ্ত প্রতীভা। উত্তম কুমার- নামটা শুনলেই চোখে ভাসে তার অবয়ব। পঞ্চাশের দশক থেকে আজ পর্যন্ত দুই বাংলার দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন তিনি আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন তিনি। মহানায়কের ৯৮তম জন্মদিন আজ।
মহানায়ক আজও সাধারণ মানুষের আড্ডায় কী করে জীবন্ত আছেন সেই সংক্রান্ত প্রতিবেদন উঠে এসেছে হিন্দুস্তান টাইমসে। ফিচারে তুলে ধরা হয়েছে-
“বয়সে তরুণ প্রীতম পেশায় আইটি কর্মী। উত্তম বলতে সে পাগল। আইকন হোক বা লুক, সবদিক থেকেই তাঁকে সেরা মনে করে প্রীতম। বাঙালিদের মধ্যে আদর্শ প্রেমিক উত্তম কুমার— এটাই ওর বিশ্বাস। প্রসঙ্গটা সে`ই তুলল নিখিলবাবুর কাছে, ‘উত্তম কুমারের কোনও সিনেমা তোমার সবচেয়ে ভালো লাগে?’ নিখিলবাবু ময়ূখ ভবনের কর্মী। কুড়ি বছর ধরে সার্ভিসে। উত্তম নাম শুনতেই স্যালুটের ভঙ্গি করলেন। ‘ওরে তুই কার নাম নিলি! সে যে আমাদের গুরু। জিজ্ঞেস কর কোন সিনেমা ভালো লাগে না! তাই বা বলব কী করে! সবই তো ভালো লাগে!’
— ‘যেমন যেমন, ক’টা নাম বলো।’
— ‘সাড়ে চুয়াত্তর, সন্ন্যাসী রাজা, বন পলাশির পদাবলি, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, মৌচাক আর কত বলব। তোর কোন সিনেমা ভালো লাগে বল?’
—‘সাড়ে চুয়াত্তর বেশি ভালো। ওরকম হাসির সিনেমা, অল্প বয়সের উত্তম। চাকরিতে ঢুকেছে, মেসে থাকতে থাকতে প্রেম। এ যেন আমাদের বয়সের গল্প।’
এই সময় পাশ থেকে টোন কাটে অভিষেক। ‘হ্যাঁ, তোরাই তো আমাদের সেই উত্তম-সুচিত্রা জুটি’। হেসে ওঠে সবাই। অভিষেক এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী। বয়সে প্রীতমের কাছাকাছি। সুচিত্রা বলতে আসলে বোঝালো দীপ্তাকে। এক বছর আগে দীপ্তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে প্রীতমের। ফেসবুকে উত্তম কুমারের এক গ্রুপ থেকে আলাপ। পাকেচক্রে দীপ্তা অভিষেকেরও কমন ফ্রেন্ড।
অভিষেক বলল, ‘জানেন নিখিলদা, দীপ্তা কোনও অনুষ্ঠানে গেলেই প্রীতমকে ধুতি পরতে জোর করবে। কারণ ‘উত্তম লুক’ চাই!’
প্রসঙ্গত, উত্তম বলতে পাগল বছর পঁচিশের দীপ্তাও। প্রায় সব সিনেমা দেখা। ‘নায়ক’ বিশেষ পছন্দের। কেরিয়ার নিয়ে আলোচনা হলেই সে প্রীতমকে সব শেষে বলে ‘ইউ উইল গো টু দ্য টপ দ্য টপ দ্য টপ!’ ‘আই’-এর জায়গায় ‘ইউ’ বসিয়ে!
ওদের কথার মাঝখানেই প্রমিত তুলল উত্তম কুমারের নেগেটিভ রোলের কথা। প্রীতমের বয়সি প্রমিত সিএ ফার্মে আছে। ‘ভাই যাই বল আর তাই বল, উত্তম কুমারের মতো নেগেটিভ রোল খুব কম অভিনেতাই পারে এই বাংলা সিনেমার বাজারে! বাঘবন্দি খেলা, স্ত্রী, অমানুষের মতো সিনেমা, ভাব তো? এখন তো পজিটিভ রোল করলে সহজে কেউ নেগেটিভ রোলে ঢুকতে চায় না। যুগ যুগ থাকবে উত্তম কুমারের ওই সিনেমাগুলো।’
এ কথায় সায় দিল ধীরাজ। ও বাংলার শিক্ষক। হায়ার ক্লাসের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর কথা বলল সবাইকে। ইলেভেন-টুয়েলভের ক্লাসে সিনেমা নিয়ে পড়াতে হয়। উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিয়ে একটা গোটা ক্লাস জুড়েই পড়িয়েছিল সে। কিছু দিন পর দেখা গেল বেশ কয়েক জন ছেলেমেয়ে বাংলা দারুণ ইন্টারেস্ট পেয়েছে উত্তম কুমারে। ‘নায়ক’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ দেখে এসে সেসব নিয়ে আলোচনা করে ধীরাজের সঙ্গে। অভীক বলে এক ডানপিটে ছাত্র তো আবার ‘ললনা’ বলে মেয়ে বন্ধুদের খ্যাপাতে শুরু করেছে। বিবাহিত প্রীতম বলে উঠল, ‘সিরিয়াসলি! কোনও আইন মানে না!’ সবার একজোট হাসি।
ট্রেন দমদম ছেড়েছে, বিধাননগর ঢুকবে। এবার মুখ খুললেন অনিমেষবাবু। বয়সে তিনিই সবচেয়ে বড়। বয়স আশির কাছাকাছি হলেও ঠ্যালাঠ্যালি করে ট্রেনে উঠতে পারেন। তিনি বললেন এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। ‘আমার যখন অফিস লাইফ শুরু হল, তখন সাউথের দিকে ভাড়া থাকতাম। সকাল সকাল বেরোতাম পিজি থেকে। একদিন দেখি মিন্টো পার্কে তিনি! বললে বিশ্বাস করবি না, ওই লেভেলের অভিনেতা রাস্তায় বেরিয়ে মর্নিং ওয়াক করছেন! সঙ্গে এক ছোট্ট মেয়ে। পরে জেনেছি ও সুপ্রিয়া দেবীর মেয়ে সোমা। এর পর মাঝে মাঝেই দেখতাম। আদর্শ বাঙালি বলতে যা বোঝায় উত্তমবাবু ঠিক তাই। তবে হ্যাঁ, বাঙালির গুণগুলোই বেশি ছিল তাঁর। ওরকম গ্ল্যামার নিয়েও দিব্যি দায়িত্বশীল ফ্যামিলিম্যান, ভাবাই যায় না! আমার এক বন্ধু ওর ছেলে গৌতমের বিয়েতে ইনভাইটেড ছিল। তাঁর মুখে শোনা, নিজে হাতে উত্তমবাবু সবটা সামলেছিলেন। এরকম ফ্যামিলি ম্যান কিন্তু আজকের দিনেও দরকার।’
অনিমেষবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই ট্রেন ঢুকল বিধাননগর। এবার নেমে যে যার রুটের বাস ধরার পালা। তবে আড্ডা থামল মাঝপথে। বোঝা গেল, পরে এই নিয়ে আড্ডা হবে আরও। ‘উত্তম কুমার’ নিয়ে কি আর সহজে কথা শেষ হয়!”