জজ মিয়া। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার নারকীয় ঘটনার সাথে যাঁর নাম বারবার উচ্চারিত হয়। অথচ এই জজ মিয়া তাঁর নাম নয়। তিনি ঘটনায় ঘূর্ণাক্ষরে জড়িতও নন। আদালতের রায়ে সেটি প্রমাণিতও হয়েছে। কিন্তু তারপরও সেই অপবাদের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না তিনি। জীবন সংগ্রামী সেই কথিত প্রধান আসামি জজ মিয়া ট্যাক্সি চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তাঁর প্রকৃত নাম জালাল উদ্দীন। বর্বর হামলার ওই ঘটনায় সিআইডি তাঁকে জড়িয়ে জজ মিয়া নামটি সিল মেরে দেয়। এই কালিমার দাগ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মৌচাক এলাকার একটি টিনসেড বাড়িতে দুই রুম নিয়ে বৃদ্ধা মা, ছোট বোন ও ছোট ভাইকে নিয়ে জালাল উদ্দীন ড্রাইভার বসবাস করেছেন কিছুদিন। এর আগে তিনি বসবাস করতেন রাজধানীর কদমতলী থানার রায়েরবাগ এলাকায়। বারবার বাসা বদলের কারণ তার কুখ্যাত নামের পরিচিতি। যেই এলাকায় তিনি বসবাস শুরু করেন, সেই এলাকার মানুষজন যখন জেনে যায় যে তিনি ‘জজ মিয়া’, তখনই বাসা বদল করতে হয়। এ এক বিড়ম্বনার জীবন। বিব্রতকর জীবন।
নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কেশার পাড় ইউনিয়নে জালালদের বাড়ি। ছবি: সংগৃহীত
বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে জালাল ক্ষোভ নিয়ে বলেছেন, আমি জজ মিয়া নই। আমি জালাল উদ্দীন। ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে বলেছেন, দেখুন আমার ভোটার আইডি কার্ডে জালাল উদ্দীন নাম লেখা। ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের শীর্ষ পর্যায় থেকে ঘাতকদের রক্ষা করতে আমাকে জজ মিয়া বানানো হয়।
জালাল বলেন, আমি এখন একটি পুরনো প্রাইভেটকার কিনে নিজেই ড্রাইভিং করে সংসার চালাই। এটি কিস্তিতে কিনেছি। নামের কারণে আমি সবার কাছে হাসি-তামাশার পাত্র এখন। তাই আমার কাছে কেউ মেয়েও বিয়ে দিতে চায় না। বছর দুই আগে চাঁদপুরে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু বিয়ের কিছু দিন পরে আমার স্ত্রী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন যখন জানতে পারেন আমিই সেই জজ মিয়া, তখন আমার স্ত্রীও আমাকে ছেড়ে চলে যায়। সত্যি কোনো দিনই চাপা থাকে না। যারা আমাকে আসামি করেছিল তাঁরাই এখন সত্যিকারের আসামি হয়েছে। আল্লাহ্ তাদের বিচার করছে।
গ্রেফতার হওয়ার কাহিনী স্মরণ করে তিনি বলেন, ২০০৫ সালের ৯ জুন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে হঠাৎ আমাকে আটক করে নিয়ে যায় সেনবাগ থানা। সেখানে গ্রেনেড হামলার ভিডিওচিত্র দেখিয়ে তাঁরা বলে, তুই এই ভিডিও ভালোভাবে দেখ। আমরা যাদের নাম বলবো সেই সবের নাম মুখস্থ করে আদালতে বলবি তাঁদের নির্দেশে তুই ওই হামলা চালিয়েছিস। যদি না বলিস তা হলে তোকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। তোর পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। আর বললে তোর পরিবারকে মাসে মাসে টাকা দেওয়া হবে, তোর ভাই-বোনদের চাকরি দেওয়া হবে। তোকে জেল থেকে বের করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার এই চা দোকান থেকেই আটক করা হয়েছিল জালালকে। ছবি: সংগৃহীত
কান্নাজড়িত কণ্ঠে জালাল বলেন, এভাবে আমাকে একটানা ৪ বছর ২৬ দিন হাতে-পায়ে বেড়ি পরা অবস্থায় কনডেম সেলের অন্ধকার কুঠুরিতে রাখা হয়েছিল।
হামলার ঘটনার পরপর একবার তাঁর ১৭ দিনের রিমান্ড হয়। সেই রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক ‘জবানবন্দি’ও দিতে হয়েছিল জজ মিয়াকে। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি নাকি গ্রেনেড হামলা করেছেন। হামলার নেপথ্যে সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদসহ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামও বলেন।
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। ২০০৬ সালের আগস্টে জজ মিয়ার ছোট বোন খোরশেদা বেগম সাংবাদিকদের জানান স্বীকারোক্তির জন্য সিআইডি তাদের প্রতিমাসে টাকা দেয়। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে যবনিকা পড়ে জজ মিয়াকে নিয়ে সাজানো নাটকের।
জজ মিয়া বলেন, রিমান্ডে নিয়ে মারধর ও মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ার কারণে তিনি স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁকে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে পেটানো হতো। তিনি হামলার বিষয়ে কিছুই জানতেন না। সিআইডির তৎকালীন কর্মকর্তারা অন্যায়ভাবে তাঁকে ২১ আগস্ট মামলায় জড়িয়ে তাঁর জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে।
জজ মিয়ার ভাষ্য, ওই মামলার খরচ চালাতে গিয়ে তাদের নোয়াখালীর সেনবাগে যে পৈত্রিক ভিটে ছিল সেটা বিক্রি করতে হয়েছে। এখন তিনি নিঃস্ব। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের একটি ভাড়া বাসায় চার বছরের কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে বাস করেন। মৌসুমী ব্যবসায়ী হিসেবে এটা-সেটা বিক্রি করে সংসার চালান। মাঝেমধ্যে ট্যাক্সি চালান।
জজ মিয়া জানান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের মাধ্যমে তিনি গাড়িচালক হিসেবে একটি চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু করোনার সময় সেই চাকরি চলে যায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একবার চার লাখ টাকা পেয়েছিলেন। সেটা মায়ের চিকিৎসাতেই খরচ হয়েছিল। মা জোবেদা খাতুনকেও বাঁচাতে পারেননি। চার বছর আগে তিনি মারা যান।
জজ মিয়া বলেন, এখন একটা স্থায়ী চাকরি দরকার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একাধিকবার আবেদন করেছি।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সমাবেশে ওই গ্রেনেড হামলা হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাই ছিলেন সেই হামলার লক্ষ্যবস্তু। তবে তিনি রক্ষা পান। কিন্তু ওই হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন আরও কয়েকশ। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। গ্রেনেড হামলার জন্য ওই সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা তখন আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেছিল। হামলার পরের বছর ৯ জুন বীরকোট গ্রাম থেকে জালালকে গ্রেফতার করে 'জজ মিয়া' নাম দিয়ে তাঁকে ঢাকায় এনে তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তারা দাবি করেন, তিনিই এ হামলার মূল হোতা।