১২ বার ফেল করেও সফল হওয়ার গল্প

তাহির জামান প্রিয়

জানুয়ারি ১২, ২০২৪, ০৯:৫৬ পিএম

১২ বার ফেল করেও সফল হওয়ার গল্প

আজকে আমরা এমন একটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলবো যা বহুল আলোচিত। চলচ্চিত্রের নাম টুয়েলভথ ফেইল । নামটি এতো দিনে কারো কাছে অজানা নয়। ভারতের প্রখ্যাত নির্মাতা বিধু বিনোদ চোপড়ার এই অসাধারণ চলচ্চিত্রটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত।

যারা এখনো দেখেননি চলচ্চিত্রটি বাকেট লিস্টে নামটি টুকে রাখুন। এখনকার সাইফাই আর একশন জনরার বিপরীতে জীবনের গল্প বলে যাওয়া সিনেমাটি আশার আলো দেখাবে অনেকের মনে।

গল্পের শুরুতেই আমরা একটি গ্রাম দেখতে পারি, চাম্বাল। যে গ্রাম পরিচিত ডাকাতদের গ্রাম নামে।

ভারতের মধ্যপ্রেদেশের এই গ্রামটি এতোটাই দরিদ্র এবং বর্ণ বৈষম্যের শিকার যে মানুষ সেখানে অস্ত্র ধরতে বাধ্য হয়েছে, তারা নিজেদের ডাকাত বলে পরিচয় দেয়না। তারা বলে বাগী মানে বিদ্রোহী। চাম্বাল নিয়ে আগেও মুভি হয়েছে অনেক। প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খানের পান সিং তোমার এরমধ্যে অন্যতম। সেখানে চাম্বালকে খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চাম্বাল নিয়ে আরও বললে বলা যায় ফুলন দেবীর গল্প। চাম্বালের বিখ্যাত ডাকাত সর্দারনী। অনেকেই তার নাম শুনেছেন, সে বেশ প্রসিদ্ধ ছিল তার  নৃশংসতার জন্য তার ব্যাক স্টোরিও যথেষ্ট করুণ সে নিয়ে অন্য আরেকদিন আলাপ দেয়া যাবে।

চাম্বাল নিয়ে এতো কেনো বলছি যাতে গল্পটা ন্যারেট করতে আপনাদের সুবিধা হয়। এই চাম্বাল থেকেই উঠে এসেছে আমাদের গল্পের মূল প্রোটাগনিস্ট মনোজ।

সিনেমার শুরুতে দেখি মনোজ দ্বাদশ পরীক্ষার জন্য নকলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের ওখানে কোনও ছাত্রই পড়াশোনার করে পাশ করে না, নকল করে পাশ করে ।

মনোজের বাবা একজন সরকারি চাকরিজীবী। সে কোনো ঘুষ বা অসৎ পথ অবলম্বন করে চলতো না বলে একদিন মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাকে সাসপেন্ড করে দেয়া হয়। এখন পরিবার চালানোর মতো কেউ নেই, মনোজ যদি সেই বছর দ্বাদশ পাস করতে পারে, তাহলে সে একটা চাপরাসি বা পিয়নের কাজ পেয়ে যাবে। কিন্তু যে স্কুলে সে পড়তো সেখানে মাস্টাররা পর্যন্ত টুকলি করিয়ে পাস করাতো, আর এইগুলো সম্পূর্ণ গ্রামের বিধায়কের নির্দেশে হতো। দ্বাদশের অঙ্ক পরীক্ষার দিন মাস্টাররাই বোর্ডে অঙ্ক কষে পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় এবং ওই মুহূর্তে থানার ডি.এস.পি সেখানে চলে আসে আর এইসব দেখে ফেলে। এখন স্কুলের হেড যিনি সে সেই অফিসারকে ডেকে নিয়ে ঘুষ দেওয়ার ধান্দা করে। কিন্তু সেই অফিসার সেইসব প্রমানস্বরূপ ছবি তুলে গ্রেফতার করে নেয় আর সেই বছর ওই স্কুলের সব স্টুডেন্টস আবারও ফেইল করে। সেই সাথে মনোজও হতাশ হয়ে পড়ে।

এখন সে আর তার বড়ো ভাই মিলে একটা ট্যাম্পু ম্যানেজ করে আর তাতে ভাড়া টেনে সংসার চালাতে থাকে, কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনা দেখে বিধায়কের মালিকাধীন বাসের কন্ডাকটর তাদের বাধা দেয় কারণ ট্যাম্পু চললে তাদের লোকসান হচ্ছে আর ঘুষখোর কিছু পুলিশ  লেলিয়ে দিয়ে তাদের থানায় ভরে দেয়, পুলিশ তার ভাই এবং তাকে লকআপে যখন পেটাতে থাকে মনোজ প্রতিবাদ করে উঠে। মনোজের ভাইও ক্ষিপ্ত হয়ে বলে বাসা থেকে বন্দুক এনে গুলি চালায় দেয়।এরপর পুলিশ মনোজকে বলে যদি সে কোনো অফিসারকে বলে ছাড়াতে পারে তাহলে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে, নাহলে তার বড়ো ভাইকে মেরে দেবে। এখন মনোজ সেই ডি.এস.পি এর কাছে যায়, কারণ সে সৎ তাই অন্যায় কিছু হতে দেবেনা বলে তার বিশ্বাস। এরপর ডিএসপির বাসায় ঢুকতে গেলেই গার্ড আটকায়। চিল্লিয়ে ডিএসপিকে ডাকার পরো সে বলে সকালে আসতে।মনোজ বলে উঠে আপনি যখন এতোই সৎ সেদিন কেনো একটু দেরী করে আসেননি। আমরা পাস করে যেতাম, আমার চাকরি থাকতো। ডিএসপি এই কথা শোনার পর মনোজের সাথে গিয়ে তার ভাইকে ছাড়িয়ে আনে। ডিএসপি তাদের গাড়িতে করে বাড়িতে নামিয়ে দেয় ।মনোজ সেই গাড়িতে যেতে যেতেই তার লক্ষ্য খুঁজে পায়। তাকেও ডিএসপির মতো সৎ হতে হবে , সে তার ইচ্ছার কথা ডি এস পিকে জানায়। জিজ্ঞেস করে তার মতো হতে চাইলে সে কি করতে পারে প্রতিউত্তরে ডি এস পি হেসে জানায়, চিটিং ছাড়তে হবে।

 মনোজের দাদী তার দাদার পেনশনের টাকা মনোজকে দেয় তার স্বপ্নপূরণের জন্য।এরপর সে গোয়ালিয়র যায় ডি.এস.পি হওয়ার জন্য। কিন্তু বাসেই তার টাকা পয়সা সব চুরি হয়ে যায়।

টাকা হারিয়ে যাবার পরো ক্ষুধার্ত মনোজ আত্মসম্মান ধরে রেখে এক দোকানদারের কাছে খাবার চায় কাজ করে দেয়ার বিনিময়ে। সেখানেই আমাদের দেখা হয়ে যায় এই গল্পের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র প্রিতম পান্ডের সাথে, সে মনোজকে জানায় যে আই পি এস অফিসার ডি.এস.পি এর থেকেও বড়ো, তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় সে আইপিএস অফিসার হবে। আর তার জন্য দিল্লিতে গিয়ে upsc এর জন্য তৈরি হতে হবে। সে প্রিতমকে অনুরোধ করে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

দিল্লি এসে মনোজ ভয় পেয়ে যায় এতো মানুষ দেখে। এতো এতো কম্পিটিশন সে কি পারবে। এবার মনোজের পরিচয় হয় গৌরী ভাইয়ার।

সে ছয়বার ইউ পি এস সি পরীক্ষার দেয় ,এটাই তার শেষ এটেম্পট। বারবার হেরে যাবার পরো যে ঘুরে দাঁড়ানো যায় গৌরী ভাইয়া সেটার উদাহরণ। সে পিছিয়ে পড়া ,প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা গরীব ছেলে মেয়েদের ফ্রিতে কোচিং করায়। তার ধারণা কেউ একজন তাদের মধ্যে আই পি এস অফিসার হলে তার মতো সবার জিতে যাওয়া সেখানে। এই সিনেমাতেও আমরা দেখি হিন্দি মিডিয়াম , ইংলিশ মিডিয়ামের চিরায়িত যোগ্যতার লড়াই। আমাদের দেশেও এই চিত্রটা বেশ কমন। গৌরী ভাইয়া তাকে একটা লাইব্রেরীতে কাজও দেয়। মনোজ থাকার জন্য রুম আর অল্প কিছু টাকা পায় মাসে সেজন্য। সে সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি টয়লেট পরিষ্কার করে, ঝাড়ু দেয়। এতে তার কখনো খারাপ লাগেনি বরং আত্ম সম্মানের সাথে কাজ করতো।

এইভাবে সে চলতে চলতে প্রথম বছর মেইনস-এ ফেইল করে। তারপরেও সে হাল ছাড়েনি তার আগ্রহ আর চেষ্টা দেখে গৌরী ভাইয়া তাকে একটা ভালো কোচিঙয়ে ভর্তি হতে বলে।সেখানেও কয়েকবার পড়ে চেষ্টা করেও মেইনস-এ পাস্ করতে পারে না। আর লাস্ট একটাই সে দিতে পারবে। এর মধ্যে শ্রদ্ধা নামের একটি মেয়ের সাথে তার পরিচয় হয় এবং তাদের দুইজনের মধ্যে সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভালোবাসায় পরিণত হয়। মনোজ শেষের দিকে আরো কঠিন জীবন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় অর্থাৎ একদিকে তার বাড়ির দিকে সংসার চালানো আর একদিকে তার মেইনস পরীক্ষার প্রিপারেশন।

সারাদিন রাত মিলিয়ে মাত্র ৬ ঘন্টা একটা ছোট রুমের মধ্যে পড়তো আর বাকি সময় আটা ভাঙাতো। এর মধ্যে শ্রদ্ধারও মেইনস ক্লিয়ার হয়ে যায় আর ইন্টারভিউতে পাস্ করে কালেক্টর হয়ে যায়। শ্রদ্ধা মনোজকে বিভিন্ন ধরণের নোটস দেয় এবং সহযোগিতা করে সমানে। তবে তাকে সেখান থেকে বের করে সেই গৌরী ভাইয়া তার বাড়িতে জায়গা দেয় আর সে পুরো ১ টা বছর মন দিয়ে পড়ে। এরপর সে মেইনস ক্লিয়ার করে এবং ইন্টারভিউ এর দিন যায় ঠিকই, কিন্তু তার ১২ ক্লাস ফেইল এর কথা শুনে প্রথমেই তাকে বের করে দেয়। কিন্তু যারা ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিল সবাই বিচার বিবেচনা করে অর্থাৎ তার সৎ আর মানবিকতার দিক বিচার করে চান্স দিয়ে দেয়।

অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা ১-২ বার ফেল মারলে আর সামনে এগোয় না, কিন্তু মনোজ এখানে লাস্ট এটেম্পট পর্যন্ত নিজেকে অনেক কষ্টে তৈরি করে আর নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে। শুধু তার নিজের স্বপ্ন বললে ভুল হবে, কারণ এটা তার বাবা-মায়েরও স্বপ্ন ছিল যে তাদের ছেলে আইপিএস অফিসার হয়ে এবং ইউনিফর্ম পরে তারপর বাড়িতে তাদের সামনে আসবে। এই মুহূর্তটা দেখার মতো ছিল।

এই সিনেমায় আমাদের সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র গৌরি ভাইয়া, তার থেকে আমরা শিখতে পারি হার বলে কিছু নেই, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে ।

 গল্পটা সফলতার গল্প হলেও এই সফলতার পেছনে যে অসফল মানুষ গুলোর শ্রম আছে সিনেমাতে তা ষোলো আনা ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতা বিধু বিনোদ চোপড়া।

একজন সফল পুরুষের পেছনে একজন নারী যে কতোটা ভূমিকা রাখতে পারে শ্রদ্ধা তার উদাহরণ।

আর প্রীতম যে পুরো গল্পটা ন্যারেট করেছে , যার সাথে পরিচয় না হলে হয়তো মনোজের আইপিএস হওয়াই সম্ভব ছিলোনা। চোখ বন্ধ করে দেখুন আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এমন বন্ধু আছে।

আর সেই ডিএসপি যার জন্য স্বপ্ন দেখার শুরু মনোজ কিন্তু তাকে ভুলে যায়নি। আইপিএস হয়েই ডি এস পির সাথে বিয়ের ইনভাইটেশন নিয়ে দেখা করতে চলে যায়।

Link copied!