বাসায় নিষিদ্ধ মাদক মারিজুয়ানা রাখার অভিযোগে ফিরিয়ে আনা ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশ মিশনের উপপ্রধান কাজী আনারকলি নাইজেরিয়ার এক বন্ধুসহ একই ছাদের নিচে বাস করতেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ওই সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস থেকে পরিচয়ের সূত্র ধরে ওই বিদেশি বন্ধুর সঙ্গেই জাকার্তার বাসা শেয়ার করতেন আনারকলি। তাদের সম্পর্ক লিভ টুগেদারের মতো। তবে কাজী আনারকলির ওই বয়ফ্রেন্ডের নাম ও তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারেনি ওই সূত্র।
কাজী আনারকলির কেলেঙ্কারির ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল থাকা অবস্থায় তার বাসার গৃহকর্মী নিখোঁজের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাকে ফেরত আনা হয়েছিল।পররাষ্ট্র ক্যাডারের ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা আনারকলিকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। ওয়াশিংটনের জোরালো প্রতিবাদের মুখে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই তাকে জরুরি পদায়ন করে জাকার্তায় বাংলাদেশ মিশনের উপপ্রধান করে পাঠানো হয়। ইন্দোনেশিয়ার ভিসা পাওয়ার পরপরই তিনি যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। কাজী আনারকলির ওই ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার বেশ বিব্রতবোধ করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সেত্র জানায়, ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশি কূটনীতিক কাজী আনারকলিকে প্রায় ২৪ ঘণ্টা বন্দি অবস্থায় দেশটির মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছিল। সেখানে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় বিশেষত ইন্দোনেশিয়া সরকারের বদান্যতায় তিনি মুক্তি পান। দূতাবাসের জিম্মায় তাকে ছাড়া হলেও শর্ত দেয়া হয় যত দ্রুত সম্ভব ইন্দোনেশিয়ার সীমানা ত্যাগ করতে। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তাৎক্ষণিক অবহিত করা হয়।
জাকার্তার বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমেই চলে আলোচনা-নেগোশিয়েশন। সূত্র বলছে, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ইন্দোনেশিয়ার মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত কঠোরতার সঙ্গে কাজী আনারকলির বাসায় অভিযান চালায় এবং মাদক উদ্ধার করে ও নাইজেরিয়ান বন্ধুসহ তাকে তুলে নিয়ে যায়।
অন্যান্য দেশ চিকিৎসা সেবায় মারিজুয়ান ব্যবহারের অনুমতি দিলেও মাদক নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কঠোর ইন্দোনেশিয়ার সরকার এখন পর্যন্ত চিকিৎসা কর্মেও মারিজুয়ানা ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। মাদক রাখা বা সেবনে যাবজ্জীবন এমনকি সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রয়েছে দেশটিতে।
সূত্র জানায়, কূটনীতিকের বাসায় মাদক রয়েছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই গত ৫ই জুলাই তারা অভিযান পরিচালনা করে। তবে তার আটক এবং মুক্তির পর দেশত্যাগে ততটা চাপ না তৈরি হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের পূর্ব নির্ধারিত ইন্দোনেশিয়া সফরের প্রস্তুতি চলায় ঢাকার পক্ষ থেকে ওই চাপ ছিল।
তদন্ত কমিটির কার্যক্রম শুরু
কাজী আনাকলির আটক বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে সরকার। এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামসকে প্রধান করে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বুধবার (৩ আগস্ট)) থেকে তদন্ত কমিটি আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করছে। তবে দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করায় তার বিরুদ্ধে আগে থেকেই তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র।
১৬ই জুলাই জাকার্তা মিশনের উপ-প্রধান কাজী আনারকলি ইন্দোনেশিয়া ছেড়ে আসার পরদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন দেশটি সফরে যান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গী হওয়া সচিব মাশফি বিনতে শামসকে বিষয়টির প্রাথমিক অনুসন্ধান করে আসতে বলা হয়েছিল। তিনি এ নিয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে এসেছেন। ওই সময়ে ইন্দোনেশিয়া সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত রিপোর্টের অনুরোধ করা হয়েছে। ওই রিপোর্ট হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে ঢাকা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনও কাজী আনারকলির বিষয়টি ভালভাবে অবগত আছেন উল্লেখ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশ মিশনের উপপ্রধান কাজী আনারকলিকে ফিরিয়ে আনার কাজটি অনেকটা চুপিসারেই করতে চেয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, “ইন্দোনেশিয়া থেকে ফিরিয়ে আনার আগেই তার তদন্তের ফাইল অনুমোদন হয়ে আছে। বুধবার (৩ জুলা্ই) বা তার পরের দিন এ বিষয়ে চিঠি ইস্যু হলেই অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হবে।”
ঘটনা ‘দুর্ভাগ্যজনক ও বিব্রতকর’: পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
বাসায় মারিজুয়ানা রাখার অপরাধে বাংলাদেশের কূটনীতিক কাজী আনারকলিকে প্রত্যাহার করা ঘটনা দেশের জন্য বিব্রতকর ও দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো: শাহরিয়ার আলম।
মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার অফিসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমরা এটা ইনভেস্টিগেট করছি। নিউজটা আমরা দেখেছি, নিউজটা শুধু দেখার বিষয় না, আমরা সেই কর্মকর্তার বিষয়ে কয়েক দিন আগ থেকেই জানি। আমরা তদন্ত করছি। এটা আমাদের জন্য বিব্রতকর।”
দোষী সাব্যস্ত হলে যথোপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে এমন আশ্বাস দিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “পররাষ্ট্র ক্যাডারের যে হাই স্ট্যান্ডার্ড, এটার সঙ্গে আমরা কখনোই কমপ্রোমাইজ করবো না। তদন্তে যদি সে (আনারকলি) দোষী সাব্যস্ত হয়, অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে, এটুকু বলতে পারি।”
ভিয়েনা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ি, কাজী আনারকলি পুরোপুরি কূটনৈতিক দায়মুক্তির আওতাধীন ছিলেন। এমতাবস্থায় বংলাদেশ সরকারকে না জানিয়ে তার বাসায় মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অভিযান কীভাবে হলো?-এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন,“ এখানে তারা কোনো ভুল করেনি। কারণ সেই বাসায় আরেকজন বিদেশি নাগরিক ছিলেন বলে আমরা শুনেছি। সেক্ষেত্রে পুলিশ যেতেই পারে।”
সহযোগিতা করার জন্য ইন্দোনেশিয়া সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অোরও বলেন, “তারা আমাদের ডিপ্লোম্যাটকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তিনি এখন আমাদের কাস্টডিতে আছেন, আমাদের নিয়ন্ত্রণই রয়েছেন। এটা আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে।”