জানুয়ারি ২৩, ২০২৩, ১২:৫৩ এএম
নাদিয়ার স্বপ্ন ছিল ফার্মাসিস্ট হবেন। বড় মেয়ের স্বপ্ন পূরণের সব ব্যবস্থা করেন বাবা পোশাক কারখানায় সহকারী মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন। কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে দুই সপ্তাহ আগে মেয়েকে ভর্তি করান রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্দানের ফার্মেসি বিভাগে। ক্লাস করতে নারায়ণগঞ্জে পরিবারকে রেখে উত্তরায় মেসে উঠেন নাদিয়া। মাত্র এক সপ্তাহ আগে স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটতে শুরু করা নাদিয়ার যাত্রা থেমে গেল বাসের ধাক্কায়।
রবিবার (২২ জানুয়ারি) ক্লাস না থাকায় বই কিনতে বন্ধুর সাথে মোটরসাইকেলে করে উত্তরার বাসা থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এসেছিলেন নাদিয়া সুলতানা (১৯)। কুড়িল বিশ্বরোড আসতেই মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দেয় ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনের একটি বাস। রাস্তায় ছিটকে পড়েন নাদিয়া। বাসটি টান দিতেই চাকায় পিষে হারিয়ে যান নাদিয়া, মুছে যায় সব স্বপ্ন।
তিন মেয়ের মধ্যে বড় নাদিয়াকে নিয়ে ছিল বড় স্বপ্ন ছিল বাবা-মায়ের। মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে ছুটে আসেন মা-বাবা। আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ।
মেয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে মা পারভিন আক্তার চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমার মা কই রে...? এক সপ্তাহ আগে ভার্সিটিতে রেজিস্ট্রেশন করে দিয়ে আসলাম। আল্লাহ এক সপ্তাহও পার হতে দিলা না। আমার মেয়েটাকে নিয়ে গেলা? আমি তোমার কাছেই আমার মাকে (মেয়ে নাদিয়া) ছেড়ে দিলাম।’ বলতে বলতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। সাথে থাকা স্বজনরা আগলে রাখেন তাঁকে।
হাসপাতালের মর্গের সামনে কাঁদতে কাঁদতে বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন বলতে থাকেন, ‘মেয়ের স্বপ্ন ছিল বড় ফার্মাসিস্ট হবে। আমার সব শেষ! ওরা আমার সব স্বপ্ন শেষ করে দিল! আমি পরিবার নিয়ে খেয়ে না-খেয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করিয়েছিলাম। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব!’ বলেই মেয়ের লাশ দেখতে মর্গের দিকে দৌড়ে যেতে শুরু করেন। আত্মীয়স্বজন তাঁকে নিবৃত্ত করেন।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে বাসের দুই চাকার মাঝে পড়ে যান নাদিয়া। বাস চালককে থামতে বলার পরও তার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে যান ওই বাসচালক। তখনই প্রাণ হারান নাদিয়া। রাস্তার অন্যপাশে পড়ার কারণে বেঁচে যান তার বন্ধু মোটরসাইকেলচালক মেহেদি। অল্প আঘাত পেয়েছেন তিনি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বাসের যাত্রী হাসান মামুন জানান, বাসটি মোটরসাইকেলটি ধাক্কা দিলে ছেলেটি পড়ে যায় ফুটপাতের দিকে এবং মেয়েটি গাড়ির দিকে। মেয়েটির মাথা বাসের সামনের ও পেছনের চাকার মাঝামাঝিতে পড়ে। চালককে বাস থামাতে বললেও না থামানোয় মেয়েটির মাথা পেছনের চাকার নিচে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় মেয়েটি।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জাহিদুল ইসলাম বলেন, চালকের কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। কারণ মোটরসাইকেলটি পড়ে যাওয়ার পর একজন চিৎকার করে বলছিল- ‘এই ড্রাইভার দাঁড়ান, বাঁচবে বাঁচবে’। তখন তো চালকের টান দেওয়া উচিত হয়নি। দাঁড়ালে অন্তত এটা বোঝা যেত যে অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘটনাটি ঘটেছে এবং সে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে; কিন্তু মাথার ওপর দিয়ে বাসটি চালিয়ে নেওয়ার ঘটনায় এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে চালকের খামখেয়ালিতে মেয়েটি মারা যায়।
এদিকে নাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে বিকেলে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান স্থায়ী ক্যাম্পাস রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের উল্টো পাশের কাওলা এলাকার ফুটওভারব্রিজের নিচে জড়ো হন তাঁর সহপাঠীসহ কয়েকশ শিক্ষার্থী। নিরাপদ সড়ক ও অভিযুক্ত চালকের বিচার দাবি করেন তাঁরা।
আবদুর রহমান নামে নাদিয়ার এক সহপাঠী বলেন, ‘মাত্র দুই দিন আমাদের ক্লাস হয়েছে। এর মধ্যে আমরা এক বন্ধুকে হারালাম।’ দায়ী চালককে দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ঢাকায় মাঝেমধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীরা মারা যাচ্ছেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন হয়। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না।
অবরোধের কারণে বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ঘণ্টাখানেক পর সন্ধ্যার দিকে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা সড়ক ছেড়ে দিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক বলেন, ‘চালককে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আমরা বলছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে চালককে গ্রেপ্তার করা হবে। পরে তাঁরা রাস্তা ছেড়ে চলে যান।’
এ বিষয়ে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় তাঁরা শোক জানিয়েছেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কিছু দাবি নিয়ে এসেছিল। জড়িতদের বিচারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলছে।
পুলিশ জানায়, তারা বাসটি জব্দ করেছে। তবে বাসের চালক ও তাঁর সহযোগী পালিয়ে গেছেন। গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
নাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় নাদিয়ার বাবা সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেছেন বলে জানান ভাটারা থানার ওসি এ বি এম আছাদুজ্জামান।