রমজান মাস সামনে রেখে আগে থেকেই খেজুর আমদানি করা হলেও নিত্যদিন খেজুরের ক্রমবর্ধমান দামে নাকাল জনসাধারণ।
রমজান মাসে খেজুরের চাহিদা বাড়াকে পুঁজি করে আমদানিকারক, কমিশন এজেন্ট, পাইকার, আড়তদার থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ীরা বাড়িয়েছে খেজুরের দাম। অন্যের কাঁধে দায় চাপিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন মূল্য বাড়ানোর বিষয়টি। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি, পরিবহন ব্যয় ও বেশি মূল্যে ক্রয়-এর মতো বিষয়গুলোকে খেজুরের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন।
আসন্ন রমজানে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে খেজুরসহ চার পণ্যের শুল্ক কর কমিয়েছে সরকার। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাব চোখে পড়েনি। আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমলেও গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছর খেজুরের দাম মানভেদে বেড়েছে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। জাহেদী খেজুরের দাম কেজি ২৫০ টাকা, দাবাস ৪৫০, সুক্কারি, কালমি, মরিয়ম বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা দরে।
রাজধানীর বাদামতলী আড়ত ঘুরে সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পাইকারি ও খুচরা দোকানের চিত্র একই।
রোজার কারণে রকম ভেদে সবধরণের খেজুরের দামই বেশি বলে জানান, মদিনা কমপ্লেক্সের আর এন এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক রাকিব হাসান। তিনি জানান, সুপ্রি খেজুর যার মূল্য রাখা হচ্ছে ২হাজার টাকা। কালমি খেজুর ৩ কেজি প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ টাকা, আজোয়া ৩ কেজি ৩ হাজার টাকা, আজোয়া প্রিমিয়াম কোয়ালিটি ৫ কেজি মূল্য ৫ হাজার টাকা গড়ে যার প্রতি কেজি মূল্য ১ হাজার টাকা। সুক্কারী ৩ কেজি ৩ হাজার টাকা, মরিয়ম ক্রাব যার মূল্য হাঁকা হচ্ছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। তিনোশিয়া ভিজা ২ হাজার ২০০ টাকা। দাবাস-এর মূল্য ৩ হাজার ৮০০ টাকা। কালমি মরিয়ম ৪ হাজার ৩০০ টাকা। ছক্কা প্যাকেটের ছড়া যার মূল্য নেয়া হচ্ছে ৩ হাজার টাকা।
মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, খেজুরের দাম কমার কোন সুযোগ নেই বরং প্রতিনয়ত এটি বাড়ছে এবং রোজার আগে আরও বাড়বে । মূলত খেজুরের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে এটি আনার অসুবিধার কথা বলেন তিনি।
এদিকে খেজুরের দাম গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা বেশি মনে হচ্ছে জানিয়ে একজন ক্রেতা বলেন আগেরবারের তুলনায় দাম এবার যথেষ্ট বেশি। আজ যে খেজুরটা ৪ হাজার ৩০০ থেকে ৪ হাজার ৪০০ টাকায় কিনেছি, সে খেজুরের দাম গত বছর ৩ হাজার ৬০০ বা তারও কম ছিল। আমি সবসময় দুই ধরনের খেজুর নিয়ে থাকি একটা মরিয়ম এবং মেদজুল খেজুর- যেটি আগে ৬ হাজারের কম ছিল, সেটি এখন প্রায় ৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
অধ্যাপক কবির আরও বলেন, রোজার আগে খেজুরের দাম বেশি, এখানে আসলে দায়বদ্ধতার শেষ নেই। আপনি দোকানিকে বলবেন সে বলবে খরচ বেড়েছে, আসলে সরকার কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে আমি আসলে জানি না সেই বিষয়টা। নিয়ন্ত্রন করা গেলে দাম কমতো। আমরা জানি সবসময় সিন্ডিকেটের কথা বলে, মন্ত্রী পর্যন্ত বলে ফেলে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা। যখন এরা শোনে সিন্ডিকেট কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। তখন ব্যবসায়ীরা আরও উৎসাহিত হয় দাম বাড়ানোর জন্।য কিছু করার নাই কারণ আপনি যতই পাওয়ারফুল হোন একটা বাজার মার্কেট কন্ট্রোল করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নাহ। এই জায়গাটিতে নজর দিতে পারলে ভালো কিছু করা সম্ভব। এই দোকানদার কিন্তু একজন ছোট আমদানিকারক তাকেও কিন্তু কেউ কন্ট্রোল করে তাকে যদি সরকার থামাতে পারতো তাহলে আমি ৬০০ টাকা কমে পেতাম।
মেসার্স আল ইউনুস এন্টারপ্রাইজ-এর স্বত্বাধিকারী আলম শিকদার বাচ্চু বলেন, অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে রমজানে সকল দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করে। কিন্তু বাংলাদেশে এটার একটা ধারাবাহিকতা চলে আসতেছে রোজা আসলেই সব কিছুর দাম চড়া হয়। খেজুরের উপর যখন শুল্ক বেড়েছে তখনই দাম বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারেও খেজুরের দাম বাড়তি অভিযোগ করে তিনি বলেন, গত বছর যেই খেজুর আমরা বিক্রি করেছি ৪ হাজার টাকা সেই খেজুর এ বছর বিক্রি করছি ৭ হজার টাকার উপরে। এর জন্য দায়ী আন্তর্জাতিক বাজার, ভ্যাট ট্যাক্স ও সিন্ডিকেট। সরকার শক্ত হাতে পদক্ষেপ নিলে এই সংকট কাটিয়ে উঠা যাবে বলেও জানান তিনি।
জামিয়াতুল আশরাফ মাদরাসার শিক্ষক মোখলেসুর রহমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, যে খেজুরটা আমরা গত বছর ২ হাজার দুইশ টাকায় কিনতাম সেটার দাম এখন ২ হাজার ৬০০ টাকা। অনেকটাই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। কেজি দরে প্রায় ১০০ টাকা বেশি।
এদিকে সংবাদমাধ্যম খালিজ টাইমসের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) খেজুরের দাম কমেছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। ফিলিস্তিন, জর্ডান এবং সৌদি আরবের মাজদুল খেজুর প্রতি কেজি পাওয়া যাচ্ছে ২০ দিরহামে। মাত্র কয়েকদিন আগে প্রতি কেজি এই খেজুরের দাম ছিল ৩০ দিরহাম। একইভাবে, রুটাব খেজুর সাধারণত ৬০ দিরহামে ৩ কেজি কিনতে পাওয়া গেলেও এখন রমজানের আগে ওই একই পরিমাণ খেজুরের দাম কমে ৪৫ দিরহামে নেমে এসেছে।
রোজার সময় খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কয়েকটি পণ্যের শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক সভায় বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন বিদেশে ১১০ টাকায় আমদানি করা খেজুরে শুল্ক দিতে হয় ১৪০ টাকা।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, সবার সহযোগিতা না পেলে বাজারে খেজুরের দাম কমানো যাবে না। খেজুর আমদানি করতে প্রকৃত দামের প্রায় দ্বিগুণ শুল্ক দিতে হয়। এনবিআর খেজুরকে বিলাসী পণ্য ধরে শুল্ক নির্ধারণ করে।
তিনি আরও বলেন, ১১০ টাকা কেজি দরে আমদানি করা খেজুরে শুল্ক দিতে হয় ১৪০ টাকা। পরে বাজারে বিক্রি করতে হয় ২৫০ টাকায়। একইভাবে ১২০ টাকা কেজির খেজুরে ২১০ টাকা শুল্ক দিয়ে বাজারে ৩৩০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। এজন্যই বাজারে খেজুরের দাম এত বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই শুল্ক যুক্ত করা হয়েছে। অথচ গত বছর এক কেজি খেজুরে মাত্র ১০ টাকা শুল্ক দিয়েছি।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত ৩৫ বছর ধরে আমি খেজুর আমদানি করি, কিন্তু কখনো শুল্ক দিতে হয়নি। আমি খেজুর আমদানি করলাম ৯০০ থেকে ১০০০ ডলারে। চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনার সাধারণ কনটেইনার খেজুরের জন্য ২৫০০ ডলার এবং হিমায়িত কনেটেইনারে খেজুরের জন্য ৪০০০ ডলার শুল্ক নির্ধারণ করেছে। এতে খেজুরের দাম দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে গেছে। আমরা এনবিআর-এ কথা বলেছি, তারা কোনো যুক্তি দেখাতে পারল না কেন এটার শুল্ক ২৫০০/৪০০০ করল। এই অ্যাসেসমেন্টে এক কার্টন খেজুর আমাকে বিক্রি করতে হবে সাড়ে ৪০০০ টাকায়, কেজি পড়বে ৪৫০ টাকা। আসলে আমরা সবাই যদি সহযোগিতা না করি, তাহলে বাজারে খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দাম রাখতে পারব না।
পণ্যের অস্বাভাবিক দাম নিয়ন্ত্রণের সরকারের কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়ে ভোক্তাদের সংগঠন-ক্যাবের সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘আমদানিকারক অথবা উৎপাদক হোলসেল ডিস্ট্রিবিউটার বা পাইকারি এবং খুচরা বিক্রেতা এই তিনটা টায়ারে সমন্বিতভাবে নজরদারি দরকার। পাইকারি বাজারে দাম কমলেও খুচরা বাজারে বলে যে আমি তো বেশি দামে কিনেছি।
এদিকে দাম আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। কার্টন আকারে আমদানি করা প্রতি কেজি খেজুর মানভেদে এখন শুল্ক দিতে হচ্ছে ১৪০ থেকে ২০৮ টাকা। যা গত বছর দিতে হয়েছিল মাত্র ১০ টাকা ৫৮ পয়সা। ৪০ কনটেইনার দামি খেজুর খালাস করতে এবার সাড়ে আট কোটি টাকা শুল্ক দিতে হয়েছে। গত বছর এ পরিমাণ খেজুরে শুল্ক ৭০ লাখ টাকা এমনটিই জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ হাজার টন। এর মধ্যে রমজানে প্রায় ৪০-৫০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা থাকে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, রমজানে খেজুরের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে এখন থেকেই তদারকি বাড়াতে হবে। তা না হলে দাম আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা।