কোরবানির ঈদ তথা পবিত্র ঈদুল আজহা যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে ব্যস্ততা। দাম নিয়ে হাঁকডাক, তোড়জোড়, দর কষাকষিও চলছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে। দম ফেলার অবকাশটুকুও নেই। এই অবস্থায়ও চোখ আটকে গেছে একজন বিক্রেতার দিকে। পরম ভালোবাসায় গরুর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর ক্রেতাদের সঙ্গে করছেন দরদাম। হাটে শত শত পুরুষ বিক্রেতার সঙ্গে তিনি একমাত্র নারী বিক্রেতা। নাম সালমা বেগম।
চট্টগ্রামের বিবিরহাট পশুর বাজারে এই বিক্রেতাকে গরু বিক্রি করতে দেখা গেছে। সালমা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গরু নিয়ে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরত্বের বিবিরহাটে এসেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) বিবিরহাটে দেখা যায়, অন্যান্য দিনের তুলনায় এদিন ক্রেতাদের ভিড় বেশি। বেচাকেনাও হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন ব্যাপারিরা। এর মধ্যে দেখা যায়- হাটে আনা গরুর পরিচর্যা করছেন সালমা। নানা উপাদানে তৈরি করছেন গরুর খাবার। গরুর যত্নআত্তির জন্য নির্দেশনা দিচ্ছেন কর্মচারীদেরও। পাশাপাশি গরু কিনতে আসা ক্রেতাদের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছেন হাসিমুখে। দম ফেলার যেন ফুরসৎ নেই তার। এবারে ১৪টি গরু নিয়ে বিবিরহাটে এসেছেন তিনি। ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলার এক ফাঁকে গণমাধ্যমে সালমা খাতুন জানান নারী বিক্রেতা হিসেবে তার কোরবানির পশু বিক্রির অভিজ্ঞতার কথা। এ প্রসঙ্গে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “কিছু সমস্যা তো থাকেই। এগুলোকে আমি গায়ে মাখি না। সব জায়গায় এমন টুকটাক সমস্যা থাকে।”
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এতদূরে গরু নিয়ে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এখানে গরুর দাম ভালো পাওয়া যায়। তাই এসেছি। আমাদের এলাকার আরও লোকজন এসেছে। আশা করছি- সবগুলো গরু বিক্রি করে ফিরতে পারবো।”
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স ও রাজশাহী কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থানার ফতেপুর গ্রামের মেয়ে সালমা। পড়াশোনা শেষ করে ২০১৬ সালে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন তিনি। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সেই চাকরিও চলে যায়। সঙ্গে ছিল পারিবারিক নানা টানাপোড়েনও। পড়াশুনা শেষ করে আর দশজনের মতো চাকরির পেছনে ছোটেননি সালমা। বেছে নিয়েছেন নানা পথ।
সংগ্রামী জীবনের গল্প বলতে গিয়ে সালমান জানান, জমানো টাকায় ফ্রিজিয়ান জাতের গাভী কিনেছেন তিনি। শুরুতে দুধ বিক্রি করতেন। গাভীটি এক বছর লালনপালন করতে গিয়ে গরুর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায়। এরপর একটি-দুটি করে অনেকগুলো গরু কিনতে থাকেন। বাড়ির পাশেই গড়ে তোলেন মরিয়ম এগ্রো নামে একটি খামার। তার খামারে এখন গরুর সংখ্যা ২০টি।
চাকরির পেছনে না ছুটে নারীরা উদ্যোক্তা হওয়ার পথ বেছে নিতে পারেন বলে মনে করেন এই নারী। বিবিরহাট পশুর বাজারের একমাত্র নারী বিক্রেতা সালমা বলেন, “গ্রামে দেখবেন সবগুলো ঘরে কয়েকটি গরু লালনপালন করা হয়। তার বেশির ভাগ দেখভাল করেন নারীরা। তাই চাইলে নারীরাও খামারি হতে পারেন। কিছু বাধাবিপত্তি সব পেশাতেই আছে। এখানেও তাই। সফলতা পেতে হলে তো কষ্ট করতে হবে। তবুও দিনশেষে আপনি তো কারও চাকরি করছেন।”
তিনি আরও বলেন, “সত্যি বলতে এই পেশায় থিতু হতে চেয়েছি তেমন নই। মাঝেমধ্যে মনে হয়েছিল ছেড়ে দিই। কিন্তু এসব প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ করি। তাদের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। এই যে লালনপালনের পর গরু বিক্রি করি, টাকা পাই। কিন্তু গরুগুলো যখন ক্রেতার হাতে তুলে দেই তখন খুব কষ্ট হয়। প্রকৃত অর্থে আমার পক্ষে এখন আর গরু লালনপালন ছাড়া অন্য কোনোকিছু করা সম্ভব নয়। আমি বাকি জীবন এদের নিয়েই কাটাতে চাই।”
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিক) একজন কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, “আমার এলাকার বিবিরহাটে একজন বোন গরু নিয়ে এসেছেন। এটি আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য অনুপ্রেরণার। বাজার সংশ্লিষ্টদের বলে দিয়েছি- তাকে যেন সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন। তিনি যেন কোনো ধরনের সমস্যায় না পড়েন। নারী হিসেবে যেন কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি না হন, সেটা আমরা দেখভাল করছি। সিটি করপোরেশনের আরও নয়টি হাট রয়েছে। অন্য কোথাও নারী বিক্রেতা আছে বলে শুনিনি।”