চুড়িহাট্টা ট্রাজেডি

পুরান ঢাকার কোন কেমিক্যাল গোডাউনই সরেনি

গোলাম রাব্বানী

ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪, ০৩:৫৮ পিএম

পুরান ঢাকার কোন কেমিক্যাল গোডাউনই সরেনি

অগ্নিকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিচার হয়নি, ভুক্তভোগীদের মেলেনি ক্ষতিপূরণ।

নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা ট্রাজেডি। লাশ ও হাতহাতের সংখ্যা দীর্ঘ হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি এখন পর্যন্ত। চুড়িহাট্টা ট্রাজেডির ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও কাগজে কলমে পুরান ঢাকা থেকে সরেনি একটিও গোডাউন। বরং নিবন্ধন না দেয়ায় বেহিসাবি গোডাউনের সংখ্যা বেড়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় বেশিরভাগ আবাসিক ভবনের নিচতলায় এখনও রাসায়নিক, সুগন্ধি ও প্লাস্টিকের ব্যবসা চলছে। ওয়াহেদ ম্যানশন সংস্কার করে বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ অনুযায়ী, বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে কোনো শিল্প ইউনিট আবাসিক এলাকায় এবং তার আশপাশে কাজ করতে পারে না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দুর্বল মনিটরিংয়ের সুযোগে সেখানে এই ব্যবসা চালু রয়েছে।

২০১৮ সাল থেকে পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল ব্যবসায় ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রেখেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ এলাকায় কোনো রাসায়নিক কারখানা বা গোডাউনের অনুমোদনও দিচ্ছে না বিস্ফোরক অধিদপ্তর। এরপরও এখানে অবৈধ ২০ হাজারের বেশি কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে বহাল তবিয়তে। তবে ডিএসসিসির হিসাবে এ এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৯২৪!

তবে বাস্তবে সেই সংখ্যা আরও বেশি। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মতে,লালবাগ, চকবাজার, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, বংশাল, কোতোয়ালি, শ্যামপুর ও কদমতলী এই আট থানায় বর্তমানে কেমিক্যালের প্রায় ২৫ হাজার অস্থায়ী দোকান, কারখানা ও গুদাম রয়েছে। এদিকে নতুন করে লাইসেন্স না দেয়ায় এখন এদের সংখ্যাটাও সরকারিভাবে করা যাচ্ছে না।

এদিকে , শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক ‘অস্থায়ী ভিত্তিতে রাসায়নিক সংরক্ষণের জন্য গুদাম নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ঢাকার শ্যামপুরে ৫৪টি গুদাম নির্মাণ সম্পন্ন করে। বিসিআইসির সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন জানান, সরকারি তহবিল থেকে ৬২ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পটিতে এখন পর্যন্ত দুটি কোম্পানি বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছে। তবে কোনোটিই স্থানান্তরিত হয়নি।

সংশোধিত প্রকল্প অনুযায়ী, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জুন মাসে। তখন শেষ না হওয়ায় ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত মেয়াদ বর্ধিত করা হয়। এই মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক প্রকল্পের পরিচালক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান জানান, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ও মাটি ভরাটের কাজ চলাকালীন জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ায় প্রকল্পের ভৌত কাজের অগ্রগতি ৬১ শতাংশ। ৩১০ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১ হাজার ৪৫৪ দশমিক ৮০ কোটি টাকা খরচ হবে।

এবিষয়ে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, অতি শিগগিরই শ্যামপুরে কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরানো হবে। আর আগামী বছরের মধ্যেই সিরাজদিখানে কেমিক্যাল গুদাম সরানোর কাজ করা হবে।

মিডফোর্ডের কেমিক্যাল ব্যবসায়ী রাজু আহমেদ বলেন, সবার স্বার্থে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করব। কিন্তু একবার সিলগালা করে রাখা, একবার শ্যামপুরে স্থানান্তর করা, পরবর্তী সময়ে আবার মুন্সীগঞ্জে যাওয়া এমনটি হলে পুরো কেমিক্যাল খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অস্থায়ী গুদামে বাড়তি খরচ না করে মুন্সীগঞ্জে সবার জন্য কেমিক্যাল গুদাম নির্মাণ করাটাই শ্রেয়তর বলে মনে করেন তিনি।

এফবিসিসিআইয়ের কেমিক্যাল ও পারফিউমারিবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, আমরা অতিদাহ্য কেমিক্যাল আগে থেকেই সরিয়ে ফেলেছি। এ ছাড়া বারবার স্থানান্তর হলে ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হবে না। বিসিক ১০ বছর ধরেও আমাদের কেমিক্যাল পল্লী দিতে পারেনি। এর দায় তারা এড়াতে পারে না।

বিচার হয়নি, মেলেনি ক্ষতিপূরণ

অগ্নিকাণ্ডের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার ও ক্ষতিপূরণ পায়নি চুড়িহাট্টার ক্ষতিগ্রস্তরা। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অগ্নিকাণ্ডের এক দিন পর নিহত হওয়া একজনের ছেলে বাদী হয়ে মামলা করেন। তদন্ত শেষে পুলিশ ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিক মোহাম্মদ হাসান সুলতান, মোহাম্মদ হোসেন সুলতান ওরফে সোহেলসহ আটজনের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র দেয় আদালতে। অন্য আসামিরা হলেন রাসায়নিক গুদামের মালিক ইমতিয়াজ আহমেদ, মোজাম্মেল ইকবাল, মোজাফফর উদ্দিন, মোহাম্মদ জাওয়াদ আতিক, মোহাম্মদ নাবিল ও কাশিফ।

অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের এপিপি মো. মাজহারুল হক জানিয়েছেন, অভিযোগপত্র দাখিলের প্রায় এক বছর পর গত ৩১ জানুয়ারি আদালত আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন। মামলায় ১৬৭ জন সাক্ষী আছেন। তারা জামিনে আছেন। কাউকে এখনও জেরা করা হয়নি। আদালত মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৪ মার্চ দিন ধার্য করেছেন বলে জানান তিনি।

Link copied!