চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। বর্তমানে বাংলাদেশের সবেচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি তিনি। ২৬ নভেম্বর রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু হয়েছে একজন আইনজীবীর। আহত হয়েছে অন্তত ২০ জন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং লাঠিচার্জ করেছে।
চিন্ময়ের গ্রেপ্তারের ঘটনায় ভারত সরকার থেকেও উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা চট্টগ্রামে মোতায়েন করা হয়েছে ১০ প্লাটুন বিজিবি। সারাদেশে একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
কে এই চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী? আর কেনইবা তাকে গ্রেপ্তার হতে হলো, কারাগারে পাঠানো হলো? আসুন জেনে নেয়া যাক এসব প্রশ্নের উত্তর।
কে এই চিন্ময়
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর আসল নাম চন্দন কুমার ধর। ভক্তরা তাকে ডাকেন ‘চিন্ময় প্রভু’ নামে।
ছয় বছর বয়স থেকেই চিন্ময় প্রভুর পারমার্থিক জীবনের সূচনা ঘটে বলে জানা যায়। মাতা জগদেশ্বরী তথা কালী মায়ের প্রতি ছোটবেলা থেকেই তার বিশেষ অনুরাগ জন্মে। তিনি পারমার্থিক অনুশীলন করেছেন একজন মায়াবাদী যোগীর তত্ত্বাবধানে। এভাবে ধীরে ধীরে তিনি কৃষ্ণের আরাধনায় বিশেষ মনোযোগী হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় ধর্মীয় অনুশীলনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন।
বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র।
চিন্ময় বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইসকনের একজন অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
যদিও ৮ নভেম্বর ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলন করে ইসকন বাংলাদেশ জানিয়েছিল যে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ইসকনের যাবতীয় কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
তবে ইতোমধ্যেই চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আটকের বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে ইসকন। তিনি ‘বাংলাদেশে ইসকনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা’ উল্লেখ করে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইসকনের সাথে সন্ত্রাসবাদের যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার কোন ভিত্তি নেই বলেও ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
কেন তিন গ্রেপ্তার হলেন
২৪ নভেম্বরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ চিন্ময়কে রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে। জাতীয় পতাকার উপরে ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করেছেন এই অভিযোগে তুলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছিল।
এর আগে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমাবেশ করে। ওই সমাবেশের পরপরই চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগ এনে মামলা করা হয়।
৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলাটি করেন বিএনপি নেতা ফিরোজ খান, যদিও দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয় বলে জানা যায়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে অবমাননা করে আগে টানানো জাতীয় পতাকার উপর সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় গোষ্ঠী ইসকনের গেরুয়া রঙের ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করে সেখানে স্থাপন করে দেয়। যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অখন্ডতাকে অস্বীকারের শামিল। আসামিরা দেশের ভেতর অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশকে অকার্যকর করার তথা রাষ্ট্রদ্রোহ কর্মে লিপ্ত।
ভারতের উদ্বেগ ও বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার ও জামিন নামঞ্জুরের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একইসাথে চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় সংখ্যালঘুদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে হামলার ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের সরকারকে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের আহ্বানও জানিয়েছে ভারত সরকার।
অন্যদিকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার সামনে বিক্ষোভ করেছেন বিজেপির বিধায়করা। তাদের সবার হাতে পোস্টারে লেখা ছিল “চিন্ময় মহাপ্রভুর নিঃশর্ত মুক্তি চাই।” ওই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
এদিকে, রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনায় যুক্ত থাকলে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, “কেউ যদি রাষ্ট্রদ্রোহের মতো ঘটনায় যুক্ত থাকে, সে যেই হোক, যত বড় নেতাই হোক, তাকে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হবে না।”
চিন্ময় দাসকে “সম্প্রদায় বিবেচনায় নয়, রাষ্ট্রের বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে” বলে জানান ক্রীড়া উপদেষ্টা।