অক্টোবর ১১, ২০২২, ১০:৫২ পিএম
দেশের মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র ও অতি দরিদ্ররা মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট এখন। বিশ্লেষকরা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে খাদ্যপণ্যের ওপর গিয়ে বেড়েছে এর প্রভাব। আর খাবারের দাম বাড়লে গরিব মানুষের কষ্ট বাড়ে কল্পনাতীতভাবে। তাঁদের জীবিকার সংকটও দেখা যায়।
জানা যায়, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে পণ্য এবং সেবার দর বৃদ্ধির হার (মূল্যস্ফীতির) ৯ শতাংশের ঘর ছাড়িয়ে গেছে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, আর সেপ্টেম্বরে তা ৯ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তৈরি করা প্রতিবেদনের এ তথ্য জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগস্টে মূল্যস্ফীতির এই হার ১১ বছর ৩ মাস বা গত ১৩৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির রেকর্ড ছিল।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে বিবিএসের প্রতিবেদনের তথ্য জানান মন্ত্রী। মঙ্গলবার পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবন থেকে অনলাইনে যুক্ত হন তিনি। এই বৈঠক শেষেই এনইসি সম্মেলন কক্ষ-২-এ ব্রিফিং হয়।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বেশি দামে আমদানি করতে হয় বলে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। এছাড়া পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে। এর বাইরে কারসাজির মাধ্যমে কেউ মূল্য বাড়ালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্রিফিংয়ে পরিকল্কপ্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বিবিএস গত দুই মাসের মূল্যস্ফীতির প্রাথমিক হিসাব করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে। শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে ওই দুই মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করা হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বুধবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকে মূল্যস্ফীতি আবার কমে যাবে। তখন নতুন চাল ও শাকসবজি বাজারে আসতে শুরু করবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি ঋণ হ্রাসসহ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ভালোভাবে কাজ করছে।’
গত আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পেট্রল, অকটেন, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম সাড়ে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর আগে এক লাফে এত বেশি দাম বাড়ানো হয়নি। তাই আগস্টের শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। এ ছাড়া যাতায়াত, পোশাক-আশাক, শিক্ষাসামগ্রীর মতো খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার দামও বাড়ে। তখন থেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করছিলেন দেশের অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করার কথা থাকলেও বিবিএস তা করেনি। এখন একসাথে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতি প্রকাশ করা হবে।
মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা বহু মানুষের আবার গরিব হওয়ার শঙ্কা থাকে।
মূল্যস্ফীতি বাড়তি বছরের শুরু থেকেই
গত জানুয়ারি থেকেই মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পরে টানা ছয় মাস মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মে মাসে তা ৭ শতাংশ ছুঁয়ে যায়। জুন মাসে গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল। এর আগে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এ বছরের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়।
যে কারণে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি
মূলত তিন-চারটি কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আগস্ট মাসে অকটেন, পেট্রল, ডিজেলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। ফলে ভোগ্য ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। আবার পরিবহন খরচও বেড়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরেই ডলারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করে। প্রতি ডলারের দাম ৮৬ থেকে বেড়ে ১০০ টাকার ওপরে উঠেছে। ফলে পণ্যের আমদানি খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, গরিব মানুষেরা এখন মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি অনুভব করছেন। শুনতে পাচ্ছি, বিদ্যুতের দাম বাড়বে। তাহলে তা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। জ্বালানি তেলের চেয়ে বিদ্যুৎ বেশি ছোঁয়াচে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তা অর্থনীতির সব জায়গায় প্রভাব ফেলবে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ মুহূর্তে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা যৌক্তিক হবে না।