জুন ২৫, ২০২৩, ১২:৫১ পিএম
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের চেয়ে ২০৮ কর্মী উদ্বৃত্ত। এদের কাজ না থাকায় অফিসে অলস সময় কাটায়, আবার অনেকে অপ্রয়োজনীয় ছুটি নিয়ে থাকে। বিপরীত চিত্রও আছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স নেই। সার্জারী, আইসিইউ, সিসিইউ, আলট্রাসনোগ্রাম ও রেডিওলজিতে জনবল সংকটে চিকিৎসা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। রোগী ও সেবাগ্রহীতাদের অসন্তুষ্টিও তাই বাড়ছে।
হাসপাতালটিতে ব্যয়ের তুলনায় আয় বেশী হলেও বেতন, ভাতা ও ঔষধ ক্রয় বাবদ বকেয়া বা অপরিশোধিত পাওনা রয়েছে ৫৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বেতন বাবদ ১০ কোটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ৮ কোটি, গ্রাচুইটি ৩১ কোটি, ঔষধ ক্রয়ের ৪ কোটি ও অন্যান্য ১৮ লাখ টাকা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)`র অনুসন্ধানে এসব চিত্র উঠে এসেছে। টিআইবি এ বিষয়ক এক বিস্তারিত প্রতিবেদন রবিবার (২৫ জুন) প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কর্মীদের চাকরিচ্যুতি ও ঢাকার বাইরে বদলির অভিযোগ রয়েছে। এনাম কমিশনের সুুপারিশ অনুসারে হাসপাতালের নিজস্ব মানব সম্পদ কাঠামো প্রস্তুত করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন সময় হাসপাতালে অপরিকল্পিত এবং অপ্রয়োজনীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এত হাসপাতালের অর্থের অপচয় ও ক্ষতি বৃদ্ধি। লোকবল ও রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস এবং অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনের প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করা, অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিচার না করার অভিযোগ রয়েছে।
এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতি ও সোসাইটির সাংবিধানিক আদেশ (পিও-২৬, ১৯৭৩) অনুসারে হাসপাতালটি পরিচালিত হলেও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির গঠন ও কমিটির সদস্য কারা হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। ফলে বাংলাদেশ রেড ক্রস/ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিডিআরসিএস)-এর চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ট্রেজারার ও ক্ষমতাসীন দলীয় রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কমিটিতে প্রাধান্য পেয়েছে এবং হাসপাতাল পরিচালনা, নিয়োগ, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, অনুদানের অর্থের আয়-ব্যয়সহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিডিআরসিএস চেয়ারম্যানকে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
সমিতি বা সংস্থার প্রধান নির্বাহী হিসাবে চেয়ারম্যান ব্যবস্থাপনা পর্ষদের মাধ্যমে সোসাইটির সকল কার্যক্রম সম্পাদন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণের বিধান থাকা এবং এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
বিডিআরসিএসকে হাসপাতালসহ সোসাইটি এবং সোসাইটি অধিভুক্ত সমিতি বা সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানসহ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমুদয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। বিডিআরসিএসের একটি মানব সম্পদ নীতি থাকলেও হাসপাতালে নিয়োগসহ এর পরিচালনায় পৃথক কোনো নীতিমালা নেই। হাসপাতালের জন্য আলাদা মানব সম্পদ কাঠামো এবং আর্গানোগ্রামও নেই। ফলে অপরিকল্পিত নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিসহ হাসপাতালের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসপাতালের উন্নয়ন কর্মকান্ড একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেও রোগীদের মানসম্মত সেবাদানের উপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে এখনো হাসপাতালে অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। বহুদিনের পুরনো ভবন হওয়ায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবিনের মোজাইক, শয্যার হাতল ও ওয়াশরুমের দরজা ভাঙ্গা, কমোডের ফ্লাশে সমস্যা, বেসিনের সাথে সংযুক্ত পাইপ নষ্ট থাকাসহ অবকাঠামোগত বিবিধ দূর্বলতা বিরাজমান। রোগীদের ব্যবহারের কিছু কিছু কেবিন এবং ইন্টার্ন ডাক্তারদের কক্ষের এসি প্রায়শই নষ্ট থাকে, কিছুদিন পরপর ঠিক করলেও তা সঠিকভাবে কাজ করে না। ইন্টার্নদের কক্ষে ডেস্ক নেই, বেসিন অনেক পুরোনো, বাথরুমের লাইট ও কমোডের হ্যান্ড পাইপ নষ্ট। ডাক্তারদের ব্যবহৃত বাথরুমগুলোর মেঝে, বেসিন ও কমোড অনেক পুরাতন। ডাক্তারদের চেম্বার ও অফিস কক্ষেরও অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। রোগী এবং ভিজিটরদের ব্যবহারে লিফটগুলো পুরোনো হওয়ায় প্রায়শই মেরামত করাতে হয়। এছাড়া, লিফটগুলো ধীরগতিতে কাজ করে। জরুরি এবং ঝুঁকিপূর্ণ রোগীকে একস্থান হতে অন্যস্থানে দ্রুত স্থানান্তরে সময়ক্ষেপণ হয় এবং রোগীর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। রোগী/রোগীর ভিজিটরদের ব্যবহারের জন্য টয়লেটের স্বল্পতা রয়েছে। বহির্বিভাগের কিছু টয়লেট ব্যবহার অনুপযোগী।
হাসপাতালটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তরিত হলেও প্রয়োজনীয় সকল রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও যন্ত্রপাতি নেই। গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা যন্ত্রপাতি যেমন লিভার, গলব্লাডার, পিত্তনালী এবং অগ্ন্যাশয়ের অবস্থা নির্ণয়, পাথর অপসারণে ইআরসিপি যন্ত্র, এমআরআই যন্ত্র, চক্ষু এবং ডেন্টাল ইউনিটে যন্ত্রপাতি, স্কিনের চিকিৎসায় লেজার যন্ত্র, মেমোগ্রাফি, বায়োপসি, টিবি পরীক্ষার যন্ত্র, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট রোগীকে শক দেওয়ার জন্য ডিফিব্রিলেটর যন্ত্র নেই। বাইপাস সার্জারি, এনজিওগ্রামসহ জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাও হাসপাতালটিতে নেই। এন্ডোসকপি ও কোলোনোস্কোপি যন্ত্রটি পুরনো হওয়ায় সেবা কার্যক্রম ব্যহত হয়। ওটিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে।
হাসপাতালে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবিনে গুমোট গন্ধ, স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল, ফ্যান ও জানালা নিয়মিত পরিস্কার না করা এবং রাস্তায় রাখা বর্জ্য থেকে কেবিনে দুর্গন্ধ আসাসহ বিবিধ অভিযোগ রয়েছে। কেবিনের রোগীর শয্যার চাদর প্রতিদিন বদলানো হয় না। রোগীর পক্ষ থেকে বলা হলেও পরিবর্তন করা হয় না, এমনকি ভর্তির পর ৪-১৫ দিনের মধ্যে মাত্র একদিন বিছানার চাদর পরিবর্তন করার অভিযোগ রয়েছে।
হাসপাতালে ভর্তি এক শিশুর মা জানান, “হাসপাতালের সুন্দর রিসিপশন দেখে মনে হয় হাসপাতালের ভিতরটাও সুন্দর ও পরিপাটি। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। দশ হাজার টাকা জমা দিয়ে ভর্তি হয়েছি, না হলে শুধুমাত্র অপরিষ্কারের জন্য অন্য হাসপাতালে চলে যেতাম। একজন রোগী সুস্থ হওয়ার জন্য হাসপাতালে আসে কিন্তু এই পরিবেশে এসে রোগী আরও অসুস্থ হয়ে যাবে, যাদের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো তারা এই হাসপাতালে সেবা নিতে আসবে না, আবার যারা একবার সেবা নিয়ে যাচ্ছে তারাও আর আসবে না।”
ভুল চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিতে উপযুক্ত পরিবেশের ঘাটতি: চিকিৎসাসেবা কাজে ডাক্তার ও নার্সদের গাফিলতি সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে। এতে কখনো কখনো রোগীরা শারীরিক এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যেমন, রোগীর ফাইল চেক না করে সুন্নতে খাতনার রোগীর গলার টনসিল অপারেশন, কর্তব্যরত নার্স কর্তৃক নির্ধারিত ওষুধ না দিয়ে অন্য ওষুধ দেওয়ায় রোগীর অবস্থার অবনতি এবং আইসিইউতে ভর্তি করানো, ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যু এবং হাসপাতালে বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।
ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের হাসপাতালে প্রবেশের দিন ও সময়সূচি নির্দিষ্ট থাকলেও অনেকক্ষেত্রে তা মানা হয় না। বহির্বিভাগে করিডোরে মেডিকেল প্রতিনিধিদের ঘোরাঘুরি এবং সেবা কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানো, চিকিৎসক ও কর্মীদের বেতন অনিয়মিত হওয়া, দীর্ঘদিন গ্রাচুয়িটির অর্থ বকেয়ার ঘটনায় কর্মীদের প্রতিবাদ সমাবেশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অবরুদ্ধ করে রাখা, কখনও নার্স কর্তৃক রোগীর সাথে খারাপ আচরণ ও জরুরি প্রয়োজনে নার্সকে ডেকে না পাওয়া, রোগী থেকে বখশিশ আদায় ইত্যাদি ধরনের ঘটনায় রোগীদের মনে উদ্বেগ ও হাসপাতাল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রশাসনিক জনবল নিয়োগ করা হয়েছে এ হাসপাতালে। মোট ৫২৮ শয্যার হাসপাতালটিতে ৬৫২ জনের অধিক জনবল রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ জনের অধিক প্রশাসনিক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত। হাসপাতালে কর্মরত কর্মীদের ২০৮ জনের সুনির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই যারা অলস সময় ও ছুটি কাটায় বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগের ফলে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা যেমন ঘটেছে, আবার হাসপাতালের প্রাত্যহিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনায় চিকিৎসক, নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতি রয়েছে।
অধ্যাপক এবং জুনিয়র চিকিৎসকের স্বল্পতা, বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যহত হয় এবং সেবাগ্রহীতাদের অসন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক কনসালটেন্টও নেই। কনসালটেন্ট রয়েছে মাত্র তিনজন। সার্জারি, আইসিইউ, সিসিইউ, আলট্রাসনোগ্রাম এবং রেডিওলজিতে চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে।
হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন ভাতা অনিয়মিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একটানা পাঁচ থেকে সাত মাসের বেতন বকেয়া থাকার নজির রয়েছে। গ্রাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ওষুধ কোম্পানির কাছে বকেয়া ওষুধের দামসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা বকেয়া রয়েছে। অবসর নেওয়া ২৩৬ জনের এককালীন গ্রাচুইটির অর্থ বকেয়া থাকা। অবসরের পর গ্রাচুইটির টাকা একাকালীন প্রদানের কথা থাকলেও টাকা না দেওয়ায় ডাক্তার, নার্স ও কর্মীরা আদালতে মামলা দায়ের করেন।