করোনাকালে বৈশ্বিক বাণিজ্যের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগেও। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশে নতুন সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই) প্রবাহ কমেছে ৩১ কোটি ৪ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ২ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে সংখ্যাটা ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।
নতুন বিনিয়োগ কম
২০১৯ সালে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ বা এফডিআই এসেছিল ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ২৪ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে তা কমে এসেছে ২৫৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ২২ হাজার ৪৭ কোটি টাকা।
তবে আগে থেকেই এ দেশে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে মোট বিনিয়োগের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে ৩৫০ কোটি ১০ লাখ ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে। ২০১৯ সালে এসেছিল ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগ বেড়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি ঋণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তিনভাবে আসে বৈদেশিক বিনিয়োগ
আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে পুঁজি দেশে আনতে পারে। এগুলো হচ্ছে:
এক. মূলধন হিসেবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি হিসেবে
দুই. দেশে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা বিদেশে না নিয়ে দেশে বিনিয়োগ করে
এবং
তিন. এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে।
এ তিন পদ্ধতির যে কোনোভাবে বিনিয়োগ করলে তা এফডিআই হিসেবে গণ্য করা হয়।
পুনরায় বিনিয়োগ বেড়েছে
২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মূল পুঁজি বিনিয়োগ বেড়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ বেড়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ কমেছে ৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ। মূলত মূল পুঁজি ও অর্জিত মুনাফা থেকে বিনিয়োগ বেশি হারে না বাড়ায় এবং এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় সার্বিকভাবে বিনিয়োগের পরিমাণও কমে গেছে। ২০১৯ সালে এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি ২৯ লাখ ডলার। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি ৫২ লাখ ডলারে। ওই সময়ে এফডিআই কমেছে ৪৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।
কোন খাতে কত বিনিয়োগ
আলোচ্য সময়ে মোট বিনিয়োগের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ, ব্যাংকিং খাতে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, টেক্সটাইলে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, টেলিকমিউনিকেশনে ১০ দশমিক ১ শতাংশ, খাদ্যে ১৩ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ। গত বছর দেশে আসা মোট এফডিআইয়ের মধ্যে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ মূল পুঁজি, ৬১ দশমিক ১ শতাংশ মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ এবং ৬ শতাংশ এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ।
আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ১ শতাংশ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডের বিনিয়োগ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, চীনের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, মিশরের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের ৬ দশমিক ১ শতাংশ, হংকংয়ের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশগুলোর ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ কম
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। এর মধ্যে গত বছর কমেছে মূলত করোনার কারণে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশে বিনিয়োগ পদ্ধতি আরও সহজ করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার করতে হবে। বিদেশিদের জন্য বরাদ্দ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ার কথা। কিন্তু বাড়ছে না কেন। এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা উচিত।
তবে বিডার পরিচালক মো. আরিফুল বলেন, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত ২৪ হাজার সেবা দিয়েছে। প্রথম ঢেউয়ে বিনিয়োগ কমলেও এখন বিনিয়োগ বাড়ছে। আগামীতে আরও বাড়বে।
ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বিনিয়োগ
২০১৭ সালে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ২১৫ কোটি ১৬ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে তা বেড়ে ৩৬১ কোটি ৩৩ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে তা আবার কমে ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারে নেমে যায়। ২০২০ সালে তা আরও কমে ২৫৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলারে নামে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে দেশে মোট ২ হাজার ৫৫০ কোটি ৮৫ লাখ ডলার এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে মূল পুঁজি এসেছে ৯১২ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মুনাফা থেকে ও ঋণ থেকে বিনিয়োগ হয়েছে বাকি ৬৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ মূল বিনিয়োগ মাত্র এক তৃতীয়াংশ।