করোনা ভাইরাসের আক্রমনে জেরবার হয়ে দুই বছর গেছে বিশ্ব অর্থনীতির ক্রান্তিকাল। সম্প্রতি আবার ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সংকট হয়েছে তীব্র। এই সংকটে ভুগছে এখন প্রায় গোটা পৃথিবীই। বিশ্বজুড়ে ২৩০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এখন খাদ্য সংকটে পড়েছে যা আগের তুলনায় প্রায় চারগুণ। শ্রীলঙ্কায় খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অবস্থাও সুখকর নয়। তবে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ থেমে গেলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলেও মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
বিশ্বের অনেক দেশেই হু হু করে বাড়ছে খাদ্যপণ্য, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম। কোনো কোনো দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে চলছে আন্দোলন, বিক্ষোভ। আন্দোলন ঠেকাতে কোথাও আবার জারি হয়েছে জরুরি অবস্থা। চলছে দমন অভিযান। এমনকি ঘটেছে সরকার পতনের ঘটনাও।
শ্রীলংকায় এক কেজি চাল ৫০০ রুপি!
চরম খাদ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার জনগণ। জ্বালানি ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অনেক বেশি। দেশটিতে শুরু হয়েছে খাদ্যের অভাব। শিশু খাদ্যেও দেখা দিয়েছে সংকট। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে দেশটির শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধারাও।
দেশটিতে এক কেজি দুধের দাম ১৯৮০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে প্রতি কেজি চালও কিনতে হচ্ছে ৫০০ টাকা দরে। বহু মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
দিন দিন মূল্যস্ফীতি চরম আকার নিচ্ছে। চিনির দাম প্রতি কেজি ২৯০ টাকায় পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ১৯৮৯ সালের গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি আবারও তৈরি হতে পারে সে দেশে।
শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোসহ অন্যান্য শহর এলাকায় স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি সাশ্রয়ে কর্মীদের ঘরে বসে অফিসের কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, শ্রীলঙ্কার সরকারি তেল ও গ্যাস কোম্পানি সিলন পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (সিপিসি) ডিজেলের দাম ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি লিটার ৪৬০ শ্রীলঙ্কান রুপি করেছে, যা গণপরিবহনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত জ্বালানি। এ ছাড়া পেট্রলের দাম ২২ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫৫০ রুপি।
পাকিস্তানে ৮ ঘন্টার বেশি লোডশেডিং
জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল এই দেশটির মুদ্রাস্ফীতি ২০% ছাড়িয়ে গেছে। রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে গত কয়েক সপ্তাহে ইতিমধ্যেই এশীয় গ্যাসের দাম আরো বাড়তে শুরু করেছে।
খাদ্য ও ওষুধের সংকট চরমে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামর্থ্য নেই পণ্য আমদানিতে চাহিদা মোতাবেক ডলার সরবরাহ করার। এমন পরিস্থিতিতে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেউলিয়া হওয়ার বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রয়েছে পাকিস্তানসহ ১২টি দেশ।
দেশটিতে রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ ব্যাপক।ফলে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানির মূল্য পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। যেখানে জানুয়ারিতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ১৬.৬ বিলিয়ন ডলার, সেখানে বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৯.৭ বিলিয়ন ডলারে।
দেশটির বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এতই বেশি হয়ে গেছে যে রাজস্বের ৪০ শতাংশ ব্যয় করতে হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের সুদ মেটাতে।পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির দামের রেকর্ড পতন হয়েছে। ১ ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি দাঁড়িয়েছে ২২৫-এ। রুপির ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে এটিই সর্বোচ্চ পতন।
দেশটিতে লোডেশেডিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা গ্রাহকের থেকে যেই পরিমাণ অর্থ নেয় তার থেকেও তাদের খরচ অনেক বেশি। ৮ ঘণ্টা লোডশেডিং দিয়েও পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। যেখানে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং ১০ ঘণ্টারও বেশি।
পাকিস্তানি পত্রিকা ন্যাশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে বিদ্যুৎ ঘাটতি ৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। দৈনিক বিদ্যুৎ চাহিদা ২৮ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, যেখানে দেশটি উৎপাদন করতে পারছে মাত্র ২২ হাজার ৪৩৫ মেগাওয়াট।
আফগানিস্তান: পেটের জ্বালা জুড়াতে সন্তান বিক্রি
বিশ্বের অন্যতম গরিব দেশ আফগানিস্তানের ৯৭ শতাংশ মানুষ বাস করেন দারিদ্রসীমার নিচে। এঁদের মধ্যে তীব্র খাদ্যাভাবে ভুগছেন দেশের অর্ধেকের বেশি, প্রায় ২.৪ কোটি মানুষ।
গত বছরের আগস্টে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর সাধারণ আফগান নাগরিকদের অবস্থা আরও খারাপের দিকে চলে যায়। দু’বেলার দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাই হয়ে দাঁড়িয়েছে দায়। ক্রমেই পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন নিজের সন্তানদের কিংবা নিজেরই শরীরের কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করে পেটের জ্বালা জুড়োতে। রাষ্ট্রসংঘের খাদ্য পরিকল্পনাকারী বিভাগ ডব্লিউএফপি’র প্রধান ডেভিড বেসলি এমনই দাবি করেছেন।
ইরানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি: আন্দালনে গুলি, হতাহত
ইউক্রেন-রাশিয়ারি যুদ্ধের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানে বেড়েই চলেছে দ্রব্যমূল্য। মুরগি, সয়াবিন তেল, ডিম এবং দুধের দাম বেড়েছে ৩০০ শতাংশের বেশি। এ নিয়েই ক্ষুব্ধ দেশটির নাগরিকরা।
অধিকারকর্মীরা জানিয়েছেন, আন্দোলন থামাতে কঠিন অবস্থান নিয়েছে সরকার। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে এরইমধ্যে অন্তত ৬ আন্দোলনকারী নিহত হয়েছে। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে গুলির শব্দ শোনা গেছে। যদিও ইরান সরকার এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নিহতের খবর প্রচার করেনি।
চাদে সব খাবারের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আফ্রিকায় খাদ্য সংকট তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে খাদ্য সংকট ঘোষণা করে চাদ। দেশের সরকার জানিয়েছে, ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য না আসার কারণেই এই সংকট তৈরি হয়েছে।
ডয়চে ভেলে’র প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির সব খাবারের দামই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এক লোফ মাংস কিনতে হচ্ছে আড়াই ডলারেরও বেশি দামে। একটি পরিবারের মাসে খাবারের পিছনে আগে খরচ হতো ৬০ হাজার ফ্রাঙ্ক। এখন তা ৯০ থেকে এক লাখ ফ্রাঙ্কে পৌঁছে গেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি।
চাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে পরিস্থিতি ক্রমশ সংকটজনক হচ্ছে। নাইজার, মালি, সুদান-- সর্বত্রই পরিস্থিতি ভয়াবহ। শুধু খাদ্য সংকট নয়, যুদ্ধের কারণে রাশিয়া কীটনাশক পাঠানোও বন্ধ করে দিয়েছে। তার ফলেও চাষে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতি যদি চলতে থাকলে, তাহলে গোটা আফ্রিকা ভয়াবহ খাদ্য সংকটে পড়বে। যার জের গিয়ে পড়বে ইউরোপ এবং এশিয়াতেও।
বিদ্যুৎ সংকটে নাকাল উন্নত দেশও
বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের সংকট তীব্র হচ্ছে। এরই মধ্যে বিশ্বের বড় অর্থনীতি জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে প্রায় বন্ধের মুখে অর্থনীতির চাকা।
জাপানে ইয়েনের ভয়াবহ দরপতন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও টোকিওতে তীব্র তাপদাহের কারণে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশটি পড়তে যাচ্ছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ সংকটের মাঝে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অন্যতম অর্থনীতির দেশ জার্মানি জড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে। দেশটির অর্থমন্ত্রী রোবার্ট হাবেক এই সংকটকে স্মরণকালের অন্যতম আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘রাশিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ফের সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা।’
অস্ট্রেলিয়ার স্মরণকালের সবচেয়ে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট সামাল দিতে দেশটির জলবায়ু পরিবর্তন ও শক্তিবিষয়ক মন্ত্রী ক্রিস বাউন জনগণকে সাশ্রয়ী ও সংযমী হওয়ার অনুরোধ জানান।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের দাম গ্যালন প্রতি বেড়েছে ৫ ডলার। ভোক্তাদের জীবনযাত্রায় বাড়তি এই বোঝা মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দলের ওপর প্রভাব ফেলবে। কিন্তু অনেক জায়গায় জ্বালানির পেছনে জনগণের খরচ বৃদ্ধির ফলে জনদুর্ভোগ বাড়ার পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে।
পেট্রলচালিত জেনারেটরের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের জ্বালানি না পাওয়ায় নাইজেরিয়ায় অনেক সেলুনে চুল কাটতে মোবাইল ফোনের আলো ব্যবহার করছেন।
যুক্তরাজ্যে মাঝারি আকারের একটি পরিবার গাড়ির জ্বালানির পেছনে খরচ করতে হচ্ছে ১২৫ ডলার।
হাঙ্গেরিতে বেশির ভাগ জ্বালানির স্টেশনে দিনে ৫০ লিটারের বেশি তেল কিনতে দেওয়া হচ্ছে না গাড়িচালকদের। সব মিলিয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশই মুদ্রাস্ফীতির কামড়ে ধরাশায়ী। পরিস্থিতির কবে উন্নতি ঘটবে কেউ জানে না।