ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলনে কী থাকছে বিশ্বের জন্য

ফারহানা জিয়াসমিন

আগস্ট ২২, ২০২৩, ০৪:০০ পিএম

ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলনে কী থাকছে বিশ্বের জন্য

ছবি: রয়টার্স

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোট ব্রিকস। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোটটির ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন শুরু হচ্ছে আজ ২২ আগস্ট। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে বসছে এই অর্থনৈতিক আসর। চলবে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত।

ব্রিকসের ৫ সদস্য দেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকবেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতের (আইসিসি) গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকায় অংশ নিচ্ছেন না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাডিমির পুতিন।

এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের সরকারপ্রধান থাকছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ও ব্রিকসের বর্তমান চেয়ার সাইরিল রামাপোসার আমন্ত্রণে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে জোহানেসবার্গে রওনা হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিশ্বের পাঁচ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তির এই জোট মার্কিন ডলারের আধিপত্য কমাতে এক হয়ে কাজ করছে। সে কারণে এবারের সম্মেলনে প্রাধান্য পেতে পারে অভিন্ন মুদ্রা চালু, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোসহ জোট সম্প্রসারণের বিষয়টি। এছাড়াও, সম্মেলনের বাইরে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সাইডলাইন বৈঠকেও অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এই ব্রিকস সম্মেলন এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছে যে বিষয়টি নিয়ে সেটি হলো নতুন সদস্য নেওয়া। কোন দেশগুলো ব্রিকসে যুক্ত হচ্ছে এই বিষয়টির ওপরই সবার নজর থাকবে এই সম্মেলনে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশসহ ৪০টি দেশ ব্রিকসের সদস্য হতে আগ্রহী।

গত ১৪ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে ‘ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ার্ক সামিট: সোশ্যাল জাস্টিস ফর অল’ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে ব্রিকসের সদস্য দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সাথে বৈঠকের পর বাংলাদেশের ব্রিকসের সদস্য হতে চাওয়ার বিষয়টি সামনে আসে।

বিশ্বের এক চতুর্থাংশ সম্পদের মালিক ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো। বৈশ্বিক জিডিপিরও একটা বিশাল অংশ আসে এই দেশগুলো থেকেই। এ কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হতে জোটটিতে অংশ নিতে লবিংও শুরু করেছে অনেক দেশ।

ব্রিকসে যুক্ত হতে আগ্রহী ৪০টি দেশের মধ্যে রয়েছে- ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া, বলিভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, ইথিওপিয়া, কিউবা, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, কমোরোস, গ্যাবন, কাজাখস্তান এমনকি বাংলাদেশও। এদিকে এ সম্মেলনে এতগুলো দেশের ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছার পেছনে মস্কো ও বেইজিংয়ের ভূমিকা রয়েছে বলে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

ব্রিকসে নতুন সদস্যের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিশ্ব আগ্রহী হলেও ব্রিকসের যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সব সদস্য দেশের সম্মতি প্রয়োজন। এ কারণে এখনো আলোচনায় কোনো সমাধান আসছে না। কেন না ব্রিকসের সম্প্রসারণে চীন তাগিদ দিলেও ভারত ও ব্রাজিল বিরোধিতা করছে।

ব্রিকসের নতুন সদস্য নেয়ার বিষয়ে ব্রাজিলের পক্ষ থেকে আপত্তির কারণ হিসেবে জানানো হয়, সম্প্রসারণের ফলে ব্রিকস ওয়াশিংটন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী একটি সংস্থায় পরিণত হতে পারে। অন্যদিকে নতুন সদস্য নেয়ার ব্যাপারে আপত্তি না জানালেও যাদের যুক্ত করা হবে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত। ভারত জানায়, নীতিমালার মাধ্যমে নতুন সদস্য নেয়া হলে সহজেই অন্য দেশ ও সংস্থার কাছাকাছি আসা সম্ভব হবে এবং প্রয়োজনে সদস্য করে নেওয়া যাবে।

চীনের সম্প্রসারণ প্রস্তাবের পক্ষে ওয়াশিংটনে স্টিমসন সেন্টার থিংক ট্যাঙ্কের চায়না প্রোগ্রামের পরিচালক ইউন সান বলেন, জোট যত বড়, তারা তত বেশি শক্তিশালী একটি সমষ্টিগত জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে। পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে চীন উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্ব করবে।

বিশ্বজুড়ে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের মতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের মুদ্রা, বিশেষ করে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। যার প্রভাব পড়ছে অনেক দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে ‘ডি-ডলারাইজেশন’ প্রক্রিয়ার দিকে ঝুঁকছে অনেক দেশ। আর এ কারণেই ব্রিকসে যুক্ত হতে আগ্রহ বাড়ছে।

বিশ্বের অর্থনীতিতে ব্রিকসের সম্প্রসারণ কীরূপ প্রভাব ফেলবে এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টাফ্টস ইউনিভার্সিটির রাইজিং পাওয়ার অ্যালায়েন্স প্রজেক্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মিহায়েলা পাপা বলেন, ‘জোটের সম্প্রসারণ অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা। কেউ কেউ আছেন যারা ব্রিকসে সহজে ভিড়তে চায়। সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে জোটের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করা।’

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক আন্দ্রে স্পারটাকের মতে, ‘বিশ্ব উন্নয়ন নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে ব্রিকসের। এর সদস্য দেশগুলো ক্রমবর্ধমান বাজার ও উন্নয়নশীল দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নানা সংস্কার ও পরিবর্তনের জন্যও প্রস্তুত জোটটি। এতে আমার মনে হয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে।’

২০০১ সালে গোল্ডম্যান শ্যাক্সের প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিল একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেছিলেন। সেখানে তিনি ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীনের একটি জোট হওয়ার আভাস দিয়েছিলেন। আর এটি তৈরি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার উদ্যোগে।

পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন মিলে গঠিত হয় ‘ব্রিক (BRIC)’ নামে একটি অনানুষ্ঠানিক জোট। পরের বছর সে জোটে অন্তর্ভুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। তখন ‘ব্রিক’ নাম বদলে হয়ে যায় ‘ব্রিকস (BRICS)’। সময়ের সাথে সাথে এই অর্থনৈতিক জোটটি পশ্চিমা উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আখ্যায়িত হতে থাকে।

সব সদস্যদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ভূ-রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বহুপাক্ষিক বাণিজ্য এবং উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে থাকে ব্রিকস। বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-২০-তে থাকা দেশগুলোই ব্রিকসের সদস্য। জি-২০ জোটের ওপর প্রভাব তৈরি করতেই নতুন সদস্য নেয়ার কথা ভাবছে ব্রিকস এমনটাই ধারণা করছে বৈশ্বিক অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

করোনা মহামারির পর সশরীরে এবারই প্রথম সম্মেলন আয়োজন করেছে ব্রিকস। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এ সময় আসে ব্যাপক পরিবর্তন। সে কারণেই এবারের সম্মেলন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। 

Link copied!