সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৫, ১১:৪৯ এএম
ছবি: সংগৃহীত
আমার জন্মের ছয় বছর আগে ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান শাসন করতেন একজন জেনারেল। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা দখল করেন এবং নিজেকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করেন। এই পদটি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ, যেই পদটি বহু ঔপনিবেশিক দেশ স্বাধীনতার পর গ্রহণ করেছিল।
ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা ধরে রাখতে একটি যুক্তি দিতেন। সেটি হচ্ছে—তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের এই বন্ধুত্বের প্রমাণ অনেক ছবিতে পাওয়া যায়। যেমন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট জনসনের গালে হাত দিয়ে আদর করছেন। আবার প্রেসিডেন্ট জনসন করাচির রাস্তায় এক উটের গাড়িচালককে জিজ্ঞাসা করছেন, তিনি তার বন্ধু হতে চান কি না।
ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের হয়তো তাদের সম্পর্ক নিয়ে কিছু সন্দেহ ছিল। কারণ, তিনি পরে এই সম্পর্ক নিয়ে একটি বই লেখেন। বইটির নাম ছিল ‘ফ্রেন্ডস, নট মাস্টার্স’ (প্রভু নয়, বন্ধু)। এর উর্দু অনুবাদটির নাম আরও কাব্যিক ও আত্মকেন্দ্রিক ছিল—‘যিস রিজ্ক সে আতি হো পারওয়াজ মেঁ কোতাহি’।
এই বইয়ের উর্দু নামটি আমাদের জাতীয় কবি ও দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবালের একটি কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের যা কিছু দিক না কেন, তা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা দিতে পারবে না।’
পাকিস্তান একটি কৃষিপ্রধান দেশ এবং এই দেশের জমি খুবই উর্বর। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে খাবার নেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের দরকার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। কারণ, তিনি দেশের রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করতে এবং তার প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সেনাবাহিনীকে দেখাতে চেয়েছিলেন, তিনি পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষটির খুব কাছের বন্ধু।
বিনিময়ে সামরিক একনায়ক এবং করাচির উটের গাড়িচালকের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছাড়া লিন্ডন জনসন কী চেয়েছিলেন। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে তিনি চেয়েছিলেন আসলে ভূ-কৌশলগত সম্পর্ক। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের উত্তর দিকে একটি বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নজরদারি চালাতে পারে।
এখন আমার বয়স হচ্ছে প্রায় ৬০ বছর। এই সময়ে পাকিস্তানে দ্বিতীয় ফিল্ড মার্শাল এসেছেন। গত মে মাসে ভারতের সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিপজ্জনক সংঘাতের পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়। তিনি পাকিস্তানের প্রথম সেনাপ্রধান, যাকে কোনো রকম সামরিক অভ্যুত্থান না করলেও হোয়াইট হাউসে একটি সরকারি মধ্যাহ্নভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে দেখা হওয়ায় তিনি সম্মানিত। পাকিস্তান ট্রাম্পকে সেই সম্মানের জন্য মনোনীত করেছে, যা তিনি খুব করে চাচ্ছেন—নোবেল শান্তি পুরস্কার।
পাকিস্তানে নামে একটি গণতন্ত্র আছে—সংসদ, প্রধানমন্ত্রী, বিচারব্যবস্থা ও নামে স্বাধীন হলেও নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম আছে। কিন্তু দুই বছর আগে দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানকে কারাগারে পাঠানোর পর এখন সেনাবাহিনীই সবকিছুর সিদ্ধান্ত নেয়। তাই ট্রাম্প সাধারণ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সময় নষ্ট না করে সেই মানুষটির সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছেন, যিনি আসলে সব ক্ষমতা রাখেন। ট্রাম্পের এই উদ্যোগে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই পাকিস্তানের সামরিক একনায়কদের পছন্দ করে। কারণ, তাদের গোপন ও প্রকাশ্য কৌশলগত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য তারা সামরিক একনায়কদের এক জায়গায় সব সুবিধা পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র জেনারেল জিয়াউল হকের নৃশংস সামরিক স্বৈরশাসনকে সাহায্য করেছিল। কারণ, তিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীকে পরাজিত করতে ওয়াশিংটনকে সাহায্য করছিলেন।
যখন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন, তখন তিনি আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েন।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পর তৎকালীন জর্জ বুশ প্রশাসন জেনারেল মোশাররফের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। কারণ, আফগানিস্তানে হামলা চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তার সহযোগিতা দরকার ছিল। এই নতুন সম্পর্কটি যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের পুরোনো সম্পর্কের মতোই শুরু হয়েছিল।
জেনারেল মোশাররফ দাবি করেছিলেন, ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, যদি পাকিস্তান সহযোগিতা না করে তাহলে পাকিস্তানকে বোমা মেরে প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। একজন জেনারেলের আর কী করার থাকতে পারে? তিনি পূর্ণ সহযোগিতার প্রস্তাব দেন এবং আফগানিস্তানে তাদের তালেবান ভাইদের ওপর বোমা মারতে যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের বিমানঘাঁটিগুলো ব্যবহারের সুযোগ করে দেন।
এই সম্পর্ক সত্যিই ফুলেফেঁপে উঠেছিল। জেনারেল মোশাররফ ওয়াশিংটনের জন্য একজন পুরস্কার বিজয়ীর মতো কাজ করতে থাকেন। তিনি তালেবান নেতাদের এমনকি তাদের পাকিস্তানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকেও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেন।
মার্কিনরা তাদের মুখ, হাত–পা বেঁধে গোপন জায়গায় পাঠাত অথবা গুয়ানতানামো বেতে বিমানে তুলে দিত। অনেক সময় শুধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্য নির্দোষ পাকিস্তানি নাগরিকদেরও মার্কিনদের হাতে তুলে দেওয়া হতো।
ইসলামাবাদে যখন বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। তখন পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এই নোংরা সম্পর্ক বোঝাতে নানা উপমা ব্যবহার করেন। যেমন প্রতারিত, ব্যবহৃত ও ফেলে দেওয়া, অপমানিত প্রেমিক-প্রেমিকা—সবকিছুই এই বিষাক্ত সম্পর্কের বর্ণনায় ব্যবহৃত হয়েছে।
হিলারি ক্লিনটন ইসলামাবাদে এসে যখন একটি আলোচনা সভায় পাকিস্তানিদের বললেন, তারা নিজেদের উঠানে সাপ পুষছে। তখন যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক ‘শাশুড়ি’ আখ্যায়িত করা হয়েছিল, যিনি কখনো সন্তুষ্ট হন না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে পাকিস্তানের ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠানকে প্রতারক বলে বর্ণনা করেছিলেন। কারণ, ইসলামাবাদ আফগানিস্তানে ওয়াশিংটনের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে সেই পুরোনো প্রেম আবার ফিরে এসেছে। তাদের এই সম্পর্কের ভিত্তি সেই পুরোনো কারণ—‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ তাদের ‘সহযোগিতা’। গত বছর পাকিস্তান সেনাবাহিনী একজন আফগান নাগরিককে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়। ওই ব্যক্তি কাবুল বিমানবন্দরে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে অভিযোগ রয়েছে।
কাবুলে সেই হামলায় ২০০ জনের বেশি আফগান এবং ডজনখানেক মার্কিন নিহত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রথম ‘স্টেট অব দ্য নেশন’–এর ভাষণে পাকিস্তানকে ধন্যবাদ জানান।
ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নন, যিনি পাকিস্তানের এই শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে দেখে ভেবেছেন, তিনি তাদের কোনো কাজে লাগাতে পারবেন। ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরও প্রথম পাকিস্তানি জেনারেল নন, যিনি বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, যাতে কিছুটা প্রভুত্ব এবং কিছুটা বন্ধুত্ব আছে। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা ধরে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রভাব বেশ কাজে লাগে।
আসিম মুনিরের সেনাবাহিনী এখন পাকিস্তানকে বেশ চেপে ধরে রেখেছে। তারা নিজেদের পছন্দমতো শাসক দল বেছে নিতে পারে, বিরোধী দল ঠিক করে দিতে পারে, আদালতকে প্রভাবিত করতে পারে, নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে। তাদের ব্যবসার সাম্রাজ্য এখন আগের চেয়েও বেশি বিস্তৃত। আবাসন থেকে শুরু করে সার, সকালের নাশতা থেকে বিনোদন পার্ক—সবকিছুতেই তাদের ব্যবসা আছে।
কিন্তু পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর একটি বিশেষ দক্ষতা আছে। আর তা হলো পেশাদার সৈন্য হিসেবে কাজ করা। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষে তারা তাদের দক্ষতা ও প্রস্তুতি দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অবাক করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেলরা সম্ভবত লক্ষ করেছেন, তাদের পুরোনো মিত্রটি এখনো শিকার করতে পারে।
তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ভারতের বিরুদ্ধে নিজেদের বিজয় দাবি ও তা উদ্যাপন করছে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ফিল্ড মার্শাল মুনিরের মধ্যাহ্নভোজ নিয়ে গর্ব করছে, তখন দেশের ভেতরে তাদের জনপ্রিয়তা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখা, ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর), তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘আসসালামু আলাইকুম’ লিখলেও রাজনৈতিক বিরোধীদের কাছ থেকে প্রচুর গালাগালি ও অপমানজনক মন্তব্য শুনতে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাকিস্তানের ভেতরে জনপ্রিয়তার নিশ্চয়তা দেয় না। মানুষ তাদের কৌশলগত জোট এবং পাকিস্তানের ‘বিশাল তেলভান্ডার’ খোঁজার প্রতিশ্রুতির আড়ালে কী আছে, তা বুঝতে পারে। ট্রাম্প আমাদের দেশে তেল আবিষ্কারের কথা বলার পর পাকিস্তানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হাস্যরসে ভরে যায়। আমাদের পছন্দের কিছু খাবার বানাতে আমরা যেই রান্নার তেল ব্যবহার করি, তার পাত্রের ছবি দিয়ে লোকজন মিম তৈরি করেছে। এমনকি সবচেয়ে সরল পাকিস্তানিরাও বিশ্বাস করে না, পাকিস্তানে কোনো তেলভান্ডার আছে।
আগেও আমরা এই প্রেমের গল্প দেখেছি। এর শেষটা কখনোই ভালো হয়নি। এর শেষ হয়েছিল যখন আফগানিস্তানে শত শত নাগরিক মার্কিন বিমানে উঠতে গিয়ে ঝুলে থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণের কারণে দুই দশকে ৭০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি নিহত হয়েছেন। দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে কয়েক মাস পরপরই পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে যেতে হয়েছে।
পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যে মার্কিন ক্ষমতার বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভ আছে। শাসকদের ওপর জনগণ অসন্তুষ্ট হলে সেটি ঘৃণা হয়ে বিস্ফোরিত হয়। কারণ, তারা তাদের শাসকদের যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতারই অংশ হিসেবে দেখে।
ওয়াশিংটনে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে শাসকদের সম্পর্ক পরীক্ষা করার জন্য একটি দেয়াশলাই যথেষ্ট। একজন রাজনৈতিক কর্মী আমাকে একবার বলেছিলেন, যখনই তাদের দল ক্ষমতায় থাকে এবং তাদের কোনো দাবিদাওয়া থাকে, তখন তাদের শুধু একটি মার্কিন পতাকা, একটি দেয়াশলাইয়ের বাক্স আর একটি ক্যামেরা লাগে।
ওই কর্মী বলেছিলেন, ‘যদি আপনারা আমাদের দাবি মেনে না নেন, তাহলে আমরা এই দিয়াশলাই দিয়ে মার্কিন পতাকায় আগুন লাগাব এবং একটা ছবি তুলব। তারপর দেখব, যুক্তরাষ্ট্র আসলে আপনাদের সম্পর্কে কী ভাবে। বন্ধু? প্রভু? নাকি সেই পুরোনো দ্বিমুখী মিত্র, যে এখনো শিকার করতে পারে।’